আল্লাহ তাআলা মুমিনের জন্য তৈরি করে রেখেছেন চিরসুখের আবাসন—জান্নাত। এ জান্নাত কেমন, তার বর্ণনা আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে এবং বিশ্বনবী (সা.) হাদিসে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন, জান্নাত পার্থিব জীবনে যে সকল মুসলিম আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এবং পরকালীন হিসাবে যার গুনাহর চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে তাদের জন্য আল্লাহ যে সকল জান্নাত প্রস্তুত রেখেছেন। আল্লাহ্ মানুষের মনের ইচ্ছা দিয়ে সাজিয়েছেন জান্নাত! যেখানে চিরস্থায়ী । তার নায-নেয়ামত, ভোগ-বিলাস ও সকল মঞ্জিল সকল জান্নাতিরজন্যে প্রতিদান স্বরূপ ।
আল্লাহ জান্নাতিদের আহ্বান করবেন, সম্মানিত মেহমানদের ন্যায় তারা সামনে অগ্রসর হবে এবং আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। এরশাদ হচ্ছে ‘হে আমার বান্দাগণ, আজ তোমাদের কোন ভয় নাই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না।’ (যুখরুফ ৬৮)। তারা দুনিয়ার ন্যায় সেখানেও তাদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘর চিনবে। এরশাদ হচ্ছে : ‘অত:পর তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পরিচয় তিনি তাদেরকে ইতোপূর্বে দিয়েছেন।’ (মুহাম্মদ ৬)। সম্মানিত ফেরেশতাগণ তাদেরকে নিরাপদ আগমন ও উত্তম গৃহের সুসংবাদ দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে। এরশাদ হচ্ছে : ‘যারা তাদের রবকে ভয় করেছে, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হবে। অতঃপর যখন তারা তাতে আগমন করবে ও দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে, তখন তাদেরকে জান্নাতের রক্ষীরা বলবে : ‘তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখি, অতএব তোমরা এতে স্থায়ীভাবে প্রবেশ কর।’ (জুমার ৭৩)।
আর জান্নাতিরা বলবে : ‘তারা বলবে : সমস্ত প্রসংশা সে আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে এর জন্য পথ দেখিয়েছেন। যদি আল্লাহ আমাদের পথ না দেখাতেন, তবে আমরা পথ পেতাম না। আমাদের নিকট আমাদের রবের রাসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছেন। এরশাদ হচ্ছে : ‘এবং ঘোষণা দেয়া হবে, এটাই তোমাদের জান্নাত, তোমরা এর মালিক হয়েছ, তোমরা যে আমল করতে, তার বিনিময়ে।’ (আরাফ ৪৩)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘জান্নাতে তাদের প্রথম দলটি প্রবেশ করবে, পূর্ণিমা রাতের চাদের ন্যায়। অত:পর তাদের দ্বিতীয় দলটি যাবে উজ্জল নক্ষত্রের ন্যায়।’ (বুখারী-মুসলিম)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘জান্নাতিরা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের পিতা আদম আলাইহিস সালাম এর আকৃতিতে। তাদের প্রত্যেকের উচ্চতা হবে ষাট হাত।’ (বুখারী-মুসলিম)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘তাদের মাঝে পরস্পর কোন বিদ্বেষ থাকবে না, তাদের সবার অন্তর একটি অন্তরের ন্যায় থাকবে।’ (বুখারী)। এরশাদ হচ্ছে : ‘তাদের অন্তরে যে ব্যধি রয়েছে, আমি তা দূর করে দিব, তারা মুখোমুখি চেয়ারে উপবিষ্ট, সকলে ভাই-ভাই।’ (হিজর ৪৭)।
বর্ণিত আছে, জান্নাতীরা বেহেশ্তী আসনে বসে থাকবে, পক্ষিক‚ল তাদের সামনে এসে বৃক্ষের ডালে বসে নেহায়েত মি’ি মধূর কন্ঠে বলবে, জান্নাতের এমন কোন প্রস্রবণ বাকী নেই যার স্বাদ গ্রহণ করিনি । এমন কোন শরাব নেই যা পান করিনি । এমন কোন লীলাভূমি নেই যা অতিক্রম করিনি । আমার স্বাদ অসাধারণ । পক্ষিক‚লের অমন তারিফ শুনে মুমিনরা তাকে খাওয়ার আকাংখা করবে। আকাংখা অনুযায়ী পাখিটি তার দরস্তখানে ভূনা অবস্থায় তার ইচ্ছানুযায়ী এসে উপস্থিত হবে। মুমিন তার চাহিদামত ভক্ষণ করবেন। এরপর আল্লাহর হুকুমে পাখিটি জীবন্ত হয়ে উড়ে যাবে এবং অপরের সামনে সগর্বে বলবে, আমার চেয়ে সৈাভাগ্যবান আর কে আছে, আল্লাহর প্রিয় বান্দা আমাকে তার লোকমা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারপর পুনরায় সে তার আপন স্থানে বসের পূর্বের ন্যায় বলতে থাকবে।
‘হজরত যাবির (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অবশ্যই জান্নাতবাসীরা জান্নাতে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করবে। কিন্তু তাদের থুথু ফেলার, পেশাব-পায়খানা করার, কিংবা নাক ঝাড়ার প্রয়োজন হবে না। সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, তাদের ভক্ষ্যবস্তুর (পেটে) কী দশা হবে? রাসূল (সা.) বললেন, ঢেঁকুর ও পরিছন্নতার মাধ্যমে বের হবে। কিন্তু মেশকের সুগন্ধ বের হবে। আর জান্নাতবাসীদের অন্তরে আল্লাহর তাসবিহ ও তাহমিদ এমনভাবে বেঁধে দেয়া হবে যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস (অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের ন্যায় সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে থাকবে)।’ (সহীহ মুসলিম)।
‘তাতে রয়েছে দুর্ঘন্ধহীন পানির নহর; সুস্বাদু দুধের নহর; সুপেয় শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। সেখানে তাদের জন্য আরো রয়েছে, রকমারী ফল-মূল এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা।’ (মুহাম্মদ ১৫)।
তার ভেতর আরো আছে সুদীর্ঘ ছায়া, অনেক নেয়ামত, রুচিশীল ফল-ফলাদি, সুস্বাদু পাখির গোস্ত, তার পানাহার সব সময়ের জন্য উম্মুক্ত, কখনো শেষ হবে না। তার ছায়া কখনো নিঃশেষ হবে না। দীর্ঘ সময় তাতে আমোদ-প্রমোদ আয়োজন চলবে, তাতে ঘুম আসবে না, ঘুমের প্রয়োজনও হবে না। তার ফল মাখনের চেয়ে নরম, মধুর চেয়ে বেশী মি’ি। তার ফল হাতের নাগালে থাকবে, তার পানীয় সুস্বাদ্য, বৃক্ষরাজি অবনত, আনুগত্যশীল। এরশাদ হচ্ছে : ‘তার ফলসমূহ খুব নাগালের করে দেয়া হয়েছে।’ (দাহর ১৪)। আশা করার সাথে সাথেই ফলসমূহ সম্মুখে ঝুঁকে যাবে। এরশাদ হচ্ছে : ‘রেশমের আস্তর বিশি’ বিছানায় হেলান অবস্থায় থাকবে। উভয় উদ্যানের ফল অবনত থাকবে।’ (রাহমান ৪৫)। ‘পানাহার ও সহবাসের ক্ষেত্রে প্রত্যেককে একশত ব্যক্তির শক্তি প্রদান করা হবে।’ (তিরমিযি)। পানাহার ক্ষুদা নিবারণ কিংবা তৃ ‘া মিটানোর জন্য নয়, বরং স্বাদ আস্বাদন আর মস্তি করার জন্য। ‘তোমার জন্য; তুমি এতে ক্ষুদার্ধ হবে না এবং বস্ত্রহীনও হবে না। এবং তুমি এতে পিপাসার্থ হবে না, রৌদ্রে কষ্টও পাবে না।’ (সূরা ত্বহা ১১৮-১১৯)। মুদ্দা কথা জান্নাতে কষ্টদায়ক কোন বস্তু বিদ্যমান থাকবে না।
‘তারা থুতু ফালাবে না, নাকের শ্লেশা ফালাবে না এবং পায়খানাও করবে না।’ (বুখারী-মুসলিম)। ‘তাদের কারো প্রয়োজন হবে শুধু ঢেকুর তোলার, মৃগ নাভী ছিটানোর ন্যায়।’ (মুসলিম)। আল্লাহ বলেন অর্থ ‘হে আমার বান্দাগণ, তোমাদের আজ কোনো ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিত ও পেরেশান হবে না। তোমরা আমার আয়াতসমূহের বিশ্বাস স্থাপন করেছিলে এবং তোমরা আমার আজ্ঞাবহ ছিল। জান্নাতে প্রবেশ করো তোমরা এবং তোমাদের বিবিগণ সানন্দে। তাদের কাছে সোনার তৈরি ডিশ ও পানপাত্র পেশ করা হবে এবং সেখানে রয়েছে মন যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা সেখানে চিরকাল থাকবে। এই যে জান্নাতের তোমরা উত্তরাধিকারী হয়েছো, এটা তোমাদের কর্মের ফল। সেখানে তোমাদের জন্য আছে প্রচুর ফল-মূল, তা থেকে তোমরা খাবে।’ (সূরা যুমার: ৬৮-৭৩)।
সুপ্রিয় পাঠক আপনাদের যদি প্রশ্ন করা হয় তোমরা কে কে জান্নাতে যেতে চাও? নিশ্চয়ই আপনারা একবাক্যে বলবে আমরা সবাই জান্নাতে যেতে চাই। শুধু জান্নাতে যাওয়া কেন? চিরকাল জান্নাতের অধিবাসী হতে চাই। বেহেশতে যেতে চায় না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একজন মানুষ যতই পাপ করুক না কেন সে জান্নাতে যেতে চায়। জান্নাতের নাজ-নিয়ামত ভোগ করতে চায়। যারা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে এবং রাসূল (সা.) এর নির্দেশিত পথে চলবে আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে জান্নাত দান করবেন। তাদেরকে তিনি এমন জান্নাত দান করবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত। যারা সাফল্য লাভ করবে তাদের জন্য এটা আল্লাহর ওয়াদা। মুত্তাকি লোকদের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাতের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- ‘তাতে রয়েছে পানির ঝর্ণাসমূহ, চির সুস্বাদু দুধের প্রবাহ এবং পানকারীদের জন্য বিশেষ স্বাদযুক্ত পানীয়ের প্রবাহ এবং বিশুদ্ধ নহরসমূহ। ঝরনাধারা প্রবহমান হবে স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন মধুর।’ সেখানে তারা যা খেতে চাইবে তাই পাবে।পার্থিব জীবনে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার পর তা আবার শরীর থেকে বেরিয়ে না গেলে আমরা খাবার গ্রহণ করতে পারি না। এটি আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ কিংবা অভ্যাসও বটে।
কিন্তু যারা জান্নাতবাসী হবে তাদের এমন কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে না। জান্নাতবাসীরা খাবার গ্রহণের পর যখন হজম হবে তখন ঢেঁকুরের মাধ্যমে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। পুনরায় তারা খেতে চাইবে, তাদেরকে খেতে দেয়া হবে। এভাবে দিনের পর দিন চলবে। কিন্তু কোন টয়লেট কিংবা প্রাকৃতিক কাজের প্রয়োজন হবে না। আলোচ্য হাদিস অনুযায়ী ঢেঁকুর ও পরিছন্নতার মাধ্যমে তা বের হয়ে যাবে। তাদের এ ঢেঁকুরের সাথে যে গন্ধ বের হবে তা মেশকের সুগন্ধযুক্ত হবে। আল্লাহ তা’য়ালা জন্নাতবাসীদের জন্য এমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন যা দুনিয়ার কোন ব্যবস্থাপনার সাথে মিলবে না। এত সুন্দর নাজ নিয়ামত ভোগ করার আগ্রহ কার না জাগে? আমরা সবাই চাই এমন একটি সুন্দর জান্নাতের চিরস্থায়ী অধিবাসী হতে।জান্নাতে সকল প্রকার ফল-মূল পাওয়া যাবে তারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে যখনই ইচ্ছা করবে, তখনই খেতে পারবে।পরিশেষে আমরা সকলে আল্লাহ তাআলাকে বেশি বেশি ভয় করার পাশাপাশি প্রিয় নবীর দেখানো পথ ও মতে নিজেদের পরিচালিত করে তাঁর নৈকট্য অর্জন জরুরি।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন, আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন