শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লাইফস্টাইল

ডালিম খান রোগ প্রতিরোধ করুন

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

শীতকালের বিভিন্ন ফলের মধ্যে ডালিম খুবই উপকারি ফল। ফলটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি সু-স্বাদু ও পুষ্টিকর। প্রাচীনকাল থেকেই ডালিম খাদ্য এবং ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মানব দেহের রোগ প্রতিরোধে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে ডালিম। ডালিমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, বি, কে, আঁশ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি পাওয়া যায়। ডালিম গাছের বাকল, পাতা ফুল, ফল সবই মানব দেহ গঠনে কাজ করে।

উদ্ভিদ পরিচিতি : ডালিম গাছ ৫ থেকে ৮ মিটার লম্বা হয়। এ গাছের ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হলুদ ও লালচে হয়। ডালিম ছয় পার্শ্বীয় প্রায় গোলাকার খোসার ভিতরের অংশ কয়েকটি প্রকোষ্ঠ বিভক্ত এবং অসংখ্য কোনাকার রসে ভরা। স্ফটিকের মতো লাল লাল রসালো দানা থাকে। এগুলোই খাওয়া হয়। প্রায় সারা বছরই ডালিম বাজারে পাওয়া যায়। তবে শীত ও গ্রীষ্মকালে বেশী পাওয়া যায়।

রাসায়নিক উপাদান : উদ্ভিদের বাকল ও ফলের রসে থাকে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক উপাদান থাকে। এর মধ্যে পেলিটিয়েরিন, সরবিটল, ম্যানিটল, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সুক্রোজ, বিটা-সিটোস্টেরল, পেকটিন, ক্যালসিয়াম, লোহা, সোডিয়াম ও পটাসিয়াম সাইট্রিক অ্যাসিড ইত্যাদি। পাতায় থাকে বেটুলিক, আরসোলিক, অ্যাসিড এবং বিটা সিটোস্টেরল। কান্ডের বাকলে থাকে ডি-ম্যানিটল, পেলিটিয়েরিন, ফ্রিয়েডেরিন, অক্সিম ইত্যাদি। মূলের বাকলে থাকে সিউডো-পেলিটিয়েরিন, পেলিটিয়েরিন, মিথাইল, পেরিটিয়েরিন ইত্যাদি

পুষ্টি উপাদান : প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী তরতাজা ডালিমের দানায় থাকে জলীয় অংশ ৭৮ গ্রাম, খাদ্য শক্তি ৬৫ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ১.৬ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ভিটামিন বি-১, ০.০৬ মিলিগ্রাম, বি-২ ০.১ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৫৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৭০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১২ মিলিগ্রাম, আঁশ ৫.১ গ্রাম, শর্করা ১৪.৫ গ্রাম, লোহা ০.৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১২ মিলিগ্রাম, অক্সালিক এসিড ১৪ মিলি গ্রাম।

(১) বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ডালিমে ভূমিকা : ডালিমে অ্যান্টি ইনফ্লামাটরি যোগ ও ভিটামিন সি বেশী থাকায় দেহে এন্টিবডি বাড়ে। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে শক্তিশালী হয়। এতে রোগবালাই ও সংক্রমন থেকে দেহ সুস্থ থাকে।

(২) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে : ডালিমের রুপে পিউনিসিক অ্যাসিড থাকে যা কোলেস্টেরল, ট্রাই গ্লিসারাইডস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। তাছাড়া এর পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও সাহায্য করে।

(৩) খাদ্য হজমে সাহায্য করে : একটি ডালিমে প্রায় ৪৫ শতাংশ আঁশ থাকে যা প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করে খাবার হজমে সাহায্য করে। ডালিমে দ্রবনীয় ও অদ্রবনীয় দুই ধরণের আঁশই থাকে যা পাকস্থলীর কার্যকারিতা বাড়ায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং মল বের করে দিতে সাহায্য করে।

(৪) হাঁড় ভালো রাখে ঃ মানব দেহের প্রতিটি হাঁড়ের সংযোগ স্থলে কার্টিলেজ নামে তরুনাস্থি থাকে। এটি হাঁড়ের নড়াচড়ায় সাহায্য করে। ডালিমের রসে থাকা পটাশিয়াম ও পলিফেনল উপাদান হাড়ের সংযোগ স্থলে বিষ ব্যথা বা আর্থাইটিস নামক রোগ প্রতিরোধ করে। তাছাড়া তরুণাস্থির ক্ষয় ঘটায় এমন এনজাইমকে প্রতিরোধ করে। ফলে হাঁড় সুস্থ ও সবল থাকে। হাঁড়ের ক্ষয় রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

(৫) স্মৃতিশক্তি বাড়ায় : বেশী মনে রাখা যায় না এমন ব্যক্তিদের জন্য ডালিম খুবই উপকারি ফল। মাথার স্নায়ু কোষকে ডালিমের রস সতেজ ও সবল রাখে। তাই এটি অ্যালঝেইমার্স রোগীদের খুবই উপকার করে।

(৬) ভাইরাসের সংক্রমন থেকে বাঁচায় : ডালিমের দানার রসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। যা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এফলের রসে তিনি প্রকার এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে- ট্যানিন, অ্যান্থোসায়ানিন ও এলাজিক অ্যাসিড। এগুলো ভাইরাসকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। আর অ্যান্থোমায়নিন দেহ কোষকে সুস্থ সবল রাখে। ব্যাকটোরিয়া ও ভাইরাসকে থামিয়ে দেয়।

(৭) কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করে : ডালিমের এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান হার্টের মাংসপেশী গুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ ভাল রাখে। দেহ থেকে টক্সিন নামক বিষাক্ত উপাদান বের করে দেয়। দেহে ফি রেডিক্যাল প্রতিরোধ করে কোলেস্টরল বাড়তে বাধা দেয়। এর পলিফেনল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে ভালো রাখে এবং রক্তের কোলেস্টেরল জমার পক্রিয়া কমিয়ে দেয়।

(৮) ক্যান্সার প্রতিরোধ : চামড়ার ক্যান্সার প্রস্টেট ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ডালিমের রস। দেহে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ফলে ক্যান্সার কোষ নিজে থেকে মরে যায়। এ প্রক্রিয়াকে বলে অ্যাপপটোসিস।

(৯) দাঁতের যত্নে : ডালিমের রসে যে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে তা দাঁতের গোড়ায় প্লাক জমতে বাধা দেয়। জিনজিভাইটিস নামক মাড়ির রোগ প্রতিরোধ করে। ডালিমের হাইড্রোঅ্যালকোহলিক উপাদান দাঁতের অনুজীবের কারণে সৃষ্ট প্লাক থেকে রক্ষা করে।

(১০) ডায়রিয়া প্রতিরোধে ঃ ডায়রিসা হলে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। এতে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থা দেখা দিলে ডালিমের দানার রস বের করে সকাল বিকাল আধা কাপ করে কেলে পানি শূণ্যতা পূরণের পাশাপাশি শরীর ও দুর্বল হবে না। ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে আসবে।

(১১) তারুণ্য ধরে রাখে : ডালিমের রস উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল যা ত্বকে বা চামড়ায় বয়সের চাপ পড়তে দেয় না। সূর্যের তাপ ও পরিবেশের ক্ষতির পদার্থ ত্বকের ক্ষতি করে। ডালিমের রসের উপাদান চামড়ার ক্ষতিকর পদার্থকে বের করে দেয় তাছাড়া চামড়ায় উজ্জ্বলতাও বৃদ্ধি করে।

(১২) গর্ভবর্তী মায়ের উপকারে : গর্ভবর্তী মায়ের অতিরিক্ত আয়রণ সহ নানা পুষ্টি উপাদান প্রতিদিন প্রয়োজন। অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণ করে ডালিমের রস। যা বাচ্চা ও মায়ের জন্য খুবই উপকারী ফল। গর্ভকালীন অবস্থায় নিয়মিত ডালিম খেলে বাচ্চার দেহ গঠন সুস্থ ও সবল হয় এবং স্মৃতি শক্তি প্রখর হয়। তাছাড়া ভ্রুনের যথাযথ মানসিক বিকাশে ডালিমের রস খুবই উপকারি।

(১৩) মুখের রুচি বাড়ায় : জ্বর হলে মুখের স্বাদ কমে যায় বা খেতে ইচ্ছা হয় না। বা যারা খাওয়ার রুচি হয় না তারা সকাল বিকাল ৩/৪ চামচ করে ডালিমের রস খান মুখের রুচি ফিরে আসবে। হজমও ভালো হবে।

(১৪) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় : ডালিমের দানার রস ধমনীর গায়ে জমে থাকা চর্বির স্তরকে গলিয়ে পরিষ্কার করে। ফলে রক্তসঞ্চাল সঠিকভাবে হয়। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যায়।

ঔষধী গুন :
* কানো কারণে শরীরের কোষে অংশ কেটে গেলে ছিড়ে বা থেতলে গেলে রক্তপাত হলে ডালিম গাছের ফুল কচলিয়ে বা পিষে কাটা স্থানে বা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে চেপে ধরলে রক্তপাত বন্ধ হয়।

* আমাশয় নিরাময়ে ডালিমে খোসা খুবই উপকারি। যারা আমাশয় রোগী তারা তাজা বা শুকনো ডালিমের খোসা পানির মধ্যে সিদ্ধ করে এক কাপ করে কিছুক্ষণ পর পর পান করুণ উপকার পাবেন। সুতরাং ডালিমের খোসা ফেলে না দিয়ে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখুন, কাজে আসবে।

* শ্বেত প্রদর মহিলাদের একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগে মহিলাদের প্রস্রাবের রাস্তায় সাদা সাদা পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় শ্বেত প্রদাহ। এতে শরীরের শক্তি সামর্থ কমে যায়। মহিলারা শুকিয়ে যায় ও নানা রোগ শরীরে বাসা বাধে। এ রোগ থেকে বাঁচতে ডালিমের ৪/৫টি ফুল বেটে মধু সহ প্রতিদিন খেলে সমস্যা কমে আসতে পারে।

* গর্ভপাত ঠেকাতে: যেসব মহিলাদের গর্ভ সঞ্চার হয় না বা বাচ্চা ধরে রাখতে পারে না অর্থাৎ ২ বা ৩ মাসের মাথায় বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। তারা ডালিম গাছের পাতা বেটে মধু এবং দই সহ এক সাথে মিশিয়ে খেলে গর্ভপাতের আশংকা কমে যায়।

* শিশুদের ঘন ঘন পেটের গোলযোগ হলে বা পেটের পীড়ায় ভুগলে ডালিম গাছের শিকড় থেকে ছাল তুলে মধু সহ মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

* যাদের রাতের ঘুম কম হয় বা ঘুম আসে না তারা ডালিমের রসের সাথে ঘৃতকুমারীর শাঁস মিশিয়ে ২ থেকে ৪ দিন সেবন করুণ উপকার পাবেন।

সতর্কতা : যারা মানসিক রোগী এবং এ রোগের নিয়মিত ঔষধ খান তারা ডালিম খাবেন না। আর অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মতে খাবেন। যাদের শরীরে অ্যালার্জি বেশি সমস্যা করে তারা ডালিম কম খাবেন। ডালিম কারো কারো ক্ষেত্রে এ্যালার্জি বাড়িয়ে দিতে পারে। বেশী পরিমাণে ডালিম গাছের শিকড়ের রস খাবেন না। এতে বিষক্রিয়া হতে পারে। ডালিম খাওয়ার পর ধুমপান করবেন না। এতে পেটের সমস্যা হতে পারে। একই দিনে বেশী পরিমাণ একই ফল খাবেন না। যেকোন ফল খাওয়ার পর সমস্যা হলে আর খাবেন না। নিয়মিত তরতাজা ফল খান সুস্থ থাকুন।

মো: জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন