চোখের সামনেই এটি ঘটেছে, কোনও বিরতি ছাড়াই প্রায় চার মাস ধরে সেনা, ট্যাংক ও রকেট মোতায়েন করা হয়েছে। যা ধারণ করেছেন সাধারণ রুশ জনগণ তাদের সেলফোন ও ড্যাশক্যাম দিয়ে। এমনকি বাণিজ্যিক ও গোয়েন্দা স্যাটেলাইটেও বিষয়টি ধরা পড়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৯ জানুয়ারি সতর্ক করে বলেছিলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে পারেন। আর ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পুতিন কয়েক দিনের মধ্যে ইউক্রেনে আক্রমণ ও রাজধানী কিয়েভ দখলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
কিন্তু উন্মত্ত কূটনীতি, নিষেধাজ্ঞার হুমকি ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নজিরবিহীন ‘তথ্যযুদ্ধ’ বৃহস্পতিবার ভোরে ক্ষমতাহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে। ওই সময় রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের শহরগুলোতে আঘাত করে এবং সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশীর ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, পুতিন জানতেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনের হয়ে লড়াই করতে হস্তক্ষেপ করবে না। পশ্চিমা নেতারা প্রকাশ্যেই এ কথা জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ন্যাটো জোটের সদস্য ছিল না ইউক্রেন।
লন্ডনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক আরইউসিআই’র জনাথন ইয়াল বলেন, এটি ছিল সবচেয়ে অপূর্ণ অংশ। পুতিনকে যখন কেউ বলবে যে যাই ঘটুক আমরা হস্তক্ষেপ করবো না, তখন তিনি সুবিধাজনক অবস্থান পেয়ে যান। তিনি নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি মোকাবিলায় রাজি ছিলেন। কারণ, তার কাছে এটি ছিল পুষিয়ে নেওয়ার মতো। তিনি আরও বলেন, আমাদের সঙ্গে পুতিন প্রতারণা করেননি, আমাদের বিভ্রান্ত করেননি। আমরা জানতাম তিনি কী করবেন। একমাত্র সমস্যা ছিল আমরা চূড়ান্ত ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলাম না। কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়া প্রকাশ্যে পশ্চিমাদের আক্রমণ নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে মশকরা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের বিরুদ্ধে হিস্টিরিয়া ও যুদ্ধ-প্রবণতার অভিযোগ এনেছে।
পুতিনের মুখপাত্র বলেছেন, রুশ আক্রমণের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রতিবেদন নিয়ে হাসাহাসি করেছেন রুশ নেতা। হাস্যরসে তিনি উপদেষ্টাদের বলেছেন, কখন আক্রমণ শুরু হবে তা তাকে জানাতে। কিন্তু পুরো সময়জুড়ে তিনি ট্রিগারে চাপ দেওয়ার কাছাকাছি যাচ্ছিলেন।
গত বছরের নভেম্বর থেকে রাশিয়ার সামরিক সমাবেশ চলছিল। একই সমান্তরালে পুতিন কূটনৈতিক উদ্যোগ নেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের কাছ থেকে আইনি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দাবি করেন। ডিসেম্বরে ন্যাটোর কাছে এই দাবি তুলে ধরা হয়। এমনকি ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষকরাও বলেছেন, মস্কো জানতো তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হবে। তাদের দাবির মধ্যে ছিল ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং ১৯৯৭ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর মোতায়েন করা সব সামরিক অবকাঠামো সরিয়ে নেওয়া।
পশ্চিমাদের জন্য এটি ছিল একটি ফাঁদ। এতে পশ্চিমারা পা দেওয়ার ফলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কূটনীতিতে সায় না দেওয়ার অভিযোগ আনার সুযোগ পেয়ে গেছেন পুতিন। তাই তার কাছে বিষয়টি নিজের হাতে নেওয়া ছাড়া কোনও গতি ছিল না। ঠিক এই যুক্তিই তিনি পুরো সপ্তাহে তুলে ধরেছেন।
একই সঙ্গে রাশিয়ার সেনা সমাবেশ যত বাড়ছিল, ন্যাটোও পূর্ব ইউরোপে কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়। এটিকেও পুতিন পশ্চিমাদের আগ্রাসী মনোভাবের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
ইউক্রেন যে আক্রমণ শিকার হতে যাচ্ছে তা জানতো যুক্তরাষ্ট্র। হয়তো এই আক্রমণের ব্যাপ্তি ও বিশালতা নিয়ে নিশ্চিত ছিল না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বারবার বলে আসছিলেন, যে সামরিক ও প্রোপাগান্ডা প্লেবুক ক্রিমিয়া দখলে ব্যবহার করেছিল রাশিয়া, তা আবারও কাজে লাগাচ্ছে।
কিন্তু বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার হুমকি অকার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে। স্বর্ণ ও বিদেশি মুদ্রায় রাশিয়ার রিজার্ভে রয়েছে ৬৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ জ্বালানি সরবরাহকারী মস্কো।
পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিতে থাকলেও নেতারা পুতিনের আক্রমণের সিদ্ধান্ত বদলের বিষয়েই জোর দিচ্ছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, হয়তো নিষেধাজ্ঞা যুক্তিহীন কাজের মানুষকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে না। এক বিরল ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন রাশিয়ার ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ অপারেশনের তথ্য প্রকাশ করে। ব্লিনকেন জাতিসংঘে বলেছেন, এর ফলে প্রকৃত বা ভুয়া রাসায়নিক অভিযানর জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করতে পারে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দাদের এই কৌশলের প্রশংসা করছেন থিংক-ট্যাংক আরইউসিআই’র জনাথন ইয়াল। তিনি জানান, এতে পুতিন চমকে যেতে পারেন এবং তার ইচ্ছার কথা প্রমাণে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার প্রবণতা পুতিনকে কী মূল্য দিবে তা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। ইয়াল বলেন, পুতিন সবসময় সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন আমাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কী প্রত্যাশা করা যায়। কোনও পর্যায়েই আমরা তাকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার মতো পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারিনি।
পুরো সময় পুতিন কূটনীতির মধ্য দিয়ে গেছেন। বাইডেনের সঙ্গে দুটি ফোনালাপসহ ফ্রান্স ও জার্মানির নেতার সঙ্গে ক্রেমলিনে বৈঠক করেছেন। ফরাসি সূত্র জানিয়েছিল, তিন বছর আগের তুলনায় পুতিন অনেকটাই বদলে যাওয়া মানুষ। বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছিলেন, তিনি আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি। কিন্তু ইউক্রেন জোটের সদস্য হলে রাশিয়া-ন্যাটো সংঘাতের হুমকিও দিয়েছিলেন। এক ফরাসি সাংবাদিকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কি চান রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াক ফ্রান্স?
আক্রমণের আগে শেষ দশ দিনে পুতিন মিথ্যা ইঙ্গিত দিয়েছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভকে দেখা যায় তাকে বলতে কূটনৈতিক সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যায়নি এবং এই পথে চলতে পরামর্শ দেন। পরের দিনগুলোতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভিডিও প্রকাশ করে, যেগুলোতে দেখা যায় রাশিয়ার ট্যাংক ও গোলাবারুদ ইউনিট ইউক্রেনের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর্থিক বাজারে খানিকটা স্বস্তি আসে। তবে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র জানায় যে সীমান্তের আরও কাছাকাছি যাচ্ছে রুশ সেনারা এবং আরও সেনা সমাবেশ ঘটানো হচ্ছে।
পুতিনের শেষ পদক্ষেপ ছিল হস্তক্ষেপের জন্য আধা-আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। যেমনটি তিনি ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের ক্ষেত্রে করেছিলেন। ওই সময় তিনি সেটিকে বৈধতা দিতে গণভোটের আয়োজন করেন। সোমবার তিনি রুশ সমর্থিত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটি অঞ্চলের ‘স্বাধীনতা’র স্বীকৃতি দেন। আট বছর ধরে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছিল। একই সঙ্গে তাদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেন, যার আওতায় সেখানে রুশ সেনাবাহিনী ও সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার অনুমোদন দেওয়া হয়।
এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পুতিন প্রায় এক ঘণ্টা দীর্ঘ একটি ভাষণ দেন। যেখানে তিনি দাবি করেন, ইউক্রেন একটি কাগুজে রাষ্ট্র এবং কখনও প্রকৃত রাষ্ট্রীয় চরিত্র ছিল না। এখন তিনি বলছেন, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর আগ্রাসনের মাঠ। পুতিন বলেছিলেন, কিয়েভের ক্ষমতা যাদের হাতে রয়েছে তাদের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছি অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধ করার। অন্যথায় সম্ভাব্য রক্তপাত অব্যাহত রাখায় সব দায় ইউক্রেন ভূখণ্ডের শাসকদের নিতে হবে। এ ভাষণের ৪৮ ঘণ্টার কিছু সময় পর রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় স্থল, আকাশ ও নৌপথে। সূত্র : রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন