চাঁদপুরের আলোচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম খান তার ‘ফিল্ম সিটি’ সংক্রান্ত জাল কাগজপত্র দাখিল করেছেন। গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম এবং বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের ডিভিশন বেঞ্চে রিটটির শুনানি চলছে।
এ বিষয়ে এএম আমিন উদ্দিন বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে ফিল্ম সিটি অনুমোদন সংক্রান্ত যেসব কাগজপত্র দাখিল করেছেন সেলিম খান এসবই জাল। এ বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তার আইনজীবী। সরকারের এই শীর্ষ আইন কর্মকর্তা জানান, আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে ‘সিনেবাজ ফিল্ম সিটি কাম রির্সোট কাম রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং’-এর নকশা নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন এই চেয়ারম্যান।
এর আগে সেলিম খানের কৌঁসুলি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি আদালতকে বলেন, মন্ত্রীর কাছে (শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মণি) চিঠি দিয়ে সেলিম খান জমি অধিগ্রহণের জন্য আবেদন করেন। এর পর অনুমোদন হলো। এখানে স্বচ্ছতা (ক্লিন হ্যান্ড) আছে কিনা দেখতে হবে। প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সাড়ে ৬২ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য আইনের ৪ ধারায় ১৮২টি দলিলের বিষয়ে নোটিশ দেয়া হয়েছে। নোটিশ জারির পর সব দলিল বিবেচনায় নিতে হবে। ওই ১৩৯টি দলিল বাদ দিয়ে ডিসির দেয়া আদেশ সঠিক হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির জন্য যে ১৮২টি প্লট নির্বাচন করা হয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব মূল্য আছে। সেগুলো সমন্বয় করে গড় হার নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে হবে।
শুনানিকালে আদালত বলেন, আইনটি পড়লে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অধিগ্রহণের জন্য যে স্থানটি নির্ধারণ করা হয়েছে, মূল্য নির্ধারণ করতে হবে তার আশপাশের জমির দাম বিবেচনায় নিয়ে। এ বিষয়ে আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাইনুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি একমত পোষণ করেন। এ সময় আদালত বলেন, উনার (সেলিম খানের আইনজীবীর) কথা গ্রহণ করলে ব্যয় ৫৫৩ কোটি টাকা দাঁড়াচ্ছে। আর আপনারটা (ডিএজির) বিবেচনা করলে দাঁড়াচ্ছে ১৯৩ কোটি টাকা। এ সময় ডিএজি বলেন, এটা সঠিক। এরপর ডিএজি ফিল্ম সিটির অনুমোদন ও জাল তথ্য দাখিল বিষয়ে আদালতের কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন। কাজী মাইনুল হাসান আদালতে বলেন, জাল-জালিয়াতির তথ্য দাখিল করে তারা সম্পূরক এফিডেভিট দাখিল করেছেন। তাতে বলেছেন, কোনো মিথ্যা তথ্য থাকলে তার জন্য সিনিয়র আইনজীবী দায়ী থাকবেন না। এ ধরণের আবেদন জীবনে কখনো দেখিনি।
এ বিষয়ে শুনানিকালে কাজী মাইনুল হাসান আদালতকে বলেন, এই ফিল্ম সিটির অনুমোদন ছিল আইন ও বিধি বহির্ভূত। স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ২০০৯-এর অধীনে সরকার প্রণীত এক সার্কুলারে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন এলাকায় ইমারত/স্থাপনার নকশা অনুমোদন কিভাবে দেয়া হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ওই সার্কুলারে উপজেলা ও ইউনিয়নের ভবনের নকশা অনুমোদনের ব্যাপারে একটি কমিটি করা হয়। ১১ সদস্যের ওই কমিটির প্রধান হবেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বাকি ১০ সদস্যের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একজন সদস্য হিসেবে থাকবেন। এ ছাড়া ওই সার্কুলারের ৩ নম্বর নির্দেশনায় (চ) এর ১ নম্বর ধারায় বলা হয়, ইমরাত নির্মাণের জন্য ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬-এর তফসিল-১ এ উল্লিখিত আবেদনপত্রে আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্র দাখিলের পর কমিটি সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে নকশার অনুমোদন করবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান তার নিজের ফিল্ম সিটির অনুমোদন নিজেই দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত: চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন মন্ত্রিসভা থেকে চূড়ান্ত ভাবে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর। জাতীয় সংসদে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের খবর পেয়ে ২০২০ সালের মে থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত ১৩৯টি উচ্চমূল্যের জমির দলিল করে সেলিম খানসহ চার-পাঁচজনের একটি সিন্ডিকেট। পরে দলিল সম্পাদন করে ক্রয়কৃত ওইসব জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করতে সেলিম খান গত বছর ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখেন। সে অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয় গত বছর ৬ এপ্রিল। প্রশাসনিক অনুমোদন পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য সিন্ডিকেটের ১৩৯টি দাগসহ ১৮২টি দাগ চূড়ান্ত করে অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসককে প্রস্তাব করে। এরপর জমির মূল্যহার নির্ধারণ করতে গিয়ে সিন্ডিকেটের অনিয়মের আয়োজনের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আসে। এ বিষয়ে তদন্ত শেষে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অঞ্জনা খান মজলিশ গত বছর ১৬ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠান। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টিতে আনা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন