বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

খোশ আমদেদ মাহে রমজান-২০১৫

পুণ্যময় মাহে রমজান

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:১৬ এএম

বিশ্ব মুসলিমের দুয়ারে আবার এসেছে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান। রমজান হলো স্রষ্টার অসীম রহমত ও বরকতের মাস। আত্মার পরিশুদ্ধির মাস। ত্বাকওয়া অর্জনের মাস। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে এ মাস সিয়াম সাধনার মাস। পরম করুণাময় আল্লাহ্তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে যতগুলো শরিয়ত নাজিল করেছেন, তার প্রতিটিতেই ছিল এ সিয়াম সাধনা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। তাই মহাপবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসুরীদের উপর। যেন তোমরা ত্বাকওয়া অর্জন করতে পার বা মোত্তাকি হতে পার।’ ফারসি ভাষায় ‘সওম’ হলো রোজা। ‘সিয়াম’ হলো বহুবচন। উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষায়ও সিয়ামকে রোজা নামে অভিহিত করা হয়। সওম অর্থ হলো কোনও কিছু থেকে বিরত থাকা বা কোনও কিছুকে পরিত্যাগ করা। শরিয়তের ভাষায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, যৌনকর্ম এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) কর্তৃক নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা। রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, মাহে রমজান এলে এর প্রথম রাত থেকে শয়তান ও অবাধ্য জ্বিনদের শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। জাহান্নামের সব ক’টি দুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় পবিত্র জান্নাতের সব ক’টি দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং একজন ফেরেস্তা ঘোষণা করতে থাকেন, ‘হে কল্যাণকামী অনুসন্ধানী! তুমি অনুসন্ধান কর ও এগিয়ে চল। আর অকল্যাণকামী পাপাত্মাদের বলতে থাকেন, তুমি থাম।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।

রমজান মাস আসে পরম স্রষ্টার সীমাহীন অনুগ্রহ নিয়ে। মুসলিম উম্মাহর চিন্তা-চেতনায় জাগিয়ে তোলে নতুন শিহরণ। কিন্তু হায়! এতসব নিয়ামত ও অনুগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আমরা পার্থিব ভোগ বিলাসে বিভোর মানুষ পারি না এ পবিত্র মাসটিকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে। ভুলে যাই এর অফুরন্ত নিয়ামতের কথা। রোজা সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমান ও এখলাছের সঙ্গে যারা রোজা রাখে, মহান আল্লাহ তাঁদের অতীতের যাবতীয় গুণাহ মাফ করে দেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রোজাদারদের জান্নাতের রাইয়ান নামক শ্রেষ্ঠ দরওয়াজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য ডাকা হবে।’ হাদিসে আরও বলা হয়েছে, আল্লাহপাক বলেন, ‘আদম সন্তানদের সব আচরণ তার নিজের জন্য, কিন্তু ‘সিয়াম’ বা ‘রোজা’ শুধু আমার জন্য। আমি এর জন্য রোজাদারদের বিশেষ পুরষ্কারে ভূষিত করবো।’ রোজা হলো বিশ্বাসীদের কাছে ঢাল স্বরূপ। পবিত্র কুরআনে রোজার তিনটি মৌলিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। এক. ত্বাকওয়া অর্জন। দুই. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা। তিন. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার।

রমজান হলো মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম পবিত্র মাস। এ মাস সকল মুসলমানকে নিয়ে আসে এক বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায়। এক নাগাড়ে ক্রমাগত ত্রিশটি দিন, সাত’শ বিশ ঘণ্টার কঠিন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করা হয়। শেষ রাতে জেগে ‘সেহরি’ খাওয়া, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও অন্যান্য নিষিদ্ধ ও পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা, সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা, তারপর রাতের একটি বিশেষ অংশ ‘তারাবিহ’ নামাজে অতিবাহিত করা। এভাবে দীর্ঘ ত্রিশটি দিন ধর্মপ্রাণ রোজাদারদের প্রশিক্ষণ চলে। এ প্রশিক্ষণ আর কিছু নয়, এ হলো স্রষ্টার প্রতি আশরাফুল মাখলুকাত মানব সন্তানদের পরম আনুগত্য, সংযম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আন্তরিকতা। রমজান যেমন রোজার মধ্য দিয়ে আত্মার উৎকর্ষ বাড়ায় ঠিক তেমনি রমজানের ‘তারাবিহ’ নামাজ বাড়িয়ে তোলে সামাজিক চেতনাবোধ।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘রমজান, এ সেই মাস, যে মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যাতে রয়েছে সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য অনুশাসন ও তার বিস্তৃত বিশ্লেষণ। এটা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। আর এ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে ক্বদরের রাতে। পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মহিমাময় রাতে। কে জানে এ মহিমার রাত কী? মহিমামন্ডিত রাত হলো হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। এ রাতে জিব্রাইল ও ফেরেস্তারা তাঁদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে ধরায় অবতরণ করেন। এ রাত পরিপূর্ণ শান্তির রাত। ঊষার আর্বিভাব না হওয়া পর্যন্ত এর শান্তিধারা ও নিরাপত্তা অব্যাহত থাকে।’

মহাপূণ্যময় এ রাতটি কোন রাত? হেকমতের কারণে মহান আল্লাহতা’লা সেটি তার বান্দাদের জানিয়ে দেননি। তবে রাতটি হলো রমজানের শেষ দশ দিনে। অনেকের মতে, ২৭ তারিখ রাতে। কারও কারও মতে শেষ দশদিনের যেকোন বেজোড় রাত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল ক্বদর’ রমজানের শেষ দশদিনে অনুসন্ধান কর। তাই আমাদের ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ এ রাতগুলো মহিমাময় রাত মনে করে এবাদত করা উচিৎ। পবিত্র ক্বোরআনের ভাষায়, আমি সৃষ্টিলোককে নিজস্ব একটি পরিকল্পনায়, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করেছি। এ পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সারা বছরের দিনসমূহের মধ্যে একটি দিনকে সিদ্ধান্তগ্রহণকারী দিন হিসেবে গ্রহণ করেছি। দিনটি হলো মহিমামন্ডিত- ‘লাইলাতুল কদর’। কদর শব্দের দু’টি অর্থ। একটি হলো ভাগ্য বা পরিমাণ নির্ধারণ, অন্যটি হলো মহিমাময়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হাজার রাতের চাইতে শ্রেষ্ঠ এ পবিত্র রাত লাইলাতুল কদর পেয়েও যে ব্যক্তি তাকে কাজে লাগাতে, পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে পারল না, বঞ্চিত হলো, সে দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণকামী কাজ থেকে বঞ্চিত হলো। তার মত হতভাগা দুর্ভাগা কেউ নেই।’ (ইবনে মাজাহ)
পবিত্র রমজান এলো আবার বিদায়ও নিয়ে যাবে। মহান আল্লাহপাক আমাদের আগামী বছর এ মাসটি পালন করার জন্য সময় ও সুযোগ দেবেন কিনা তিনিই ভালো করে জানেন। রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করা সুন্নত। ইতেকাফ শব্দটি আরবি ‘আকফুন’ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো নির্জন স্থানে আত্মনিবেদিত হয়ে একান্তচিত্তে বসে পরম করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালার উপাসনা, নাম জিকির করা। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় মসজিদে পূর্ণ সময় অবস্থান করে ‘ইতেকাফ’ করতে হয়। মহিলারা নিজ নিজ ঘরে থেকেই ‘ইতেকাফ’ করতে পারেন। আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, ত্যাগ, তিতিক্ষা, আত্মার পবিত্রতা অর্জন, আধ্যাতিক উৎকর্ষ এবং সর্বোপরি স্রষ্টার চরম নৈকট্য লাভের এক মহান সুযোগ হলো এ ‘ইতেকাফ’। রমজানের শেষ দশদিনে ‘ইতেকাফ’ করলে চরম পরম কাক্সিক্ষত হাজার রাতের চাইতে লাইলাতুল কদরের সন্ধানলাভও সম্ভব হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন