অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম : আরবী চান্দ্র সনের নবম মাস হচ্ছে রমজান। এই মাসকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু সিয়াম পালন করার জন্য নির্ধারণ করে বিধান নাজিল করেন ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য শা’বানে। এর আগে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মুহররমের দশ তারিখে অর্থাৎ আশুরার দিনে সিয়াম পালন করেছেন। রমজানের সিয়ামের বিধান নাজিল হলে আশুরার সিয়াম নফল সিয়াম হিসেবে বিবেচিত হয়। আশুরার সিয়াম নফল সিয়ামগুলোর মধ্যে উত্তম।
রমজান মাসব্যাপী দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করে সুবিহ সাদিকের পূর্বক্ষণ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার নামই সওম বা সিয়াম। সওম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। রিপুসমূহকে দমন করার এ এক অনন্য উপায়, যা আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
সিয়াম মূলত আল্লাহ জাল্লা শানহু প্রদত্ত এমন এক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যা গ্রহণ করার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান হওয়া যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা যায়। এর দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ হয়, নিজেকে সংযমী করে তোলা যায়, তা ছাড়াও মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়, সহমর্মিতা, সমবেদনা ও সহানুভ‚তির মহা প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হওয়া যায়। যারা এই মহা সুযোগকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাদেরকে শুধু দুর্ভাগ্য বললে বোধহয় যথেষ্ট হবে না বরং তাদের মনুষ্য বলা যাবে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং সে অনুযায়ী আমল করা ছেড়ে দিলো না তার এই পানাহার ত্যাগ (সিয়াম) করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী শরীফ)
৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের রমজানের পূর্ব মাস শা’বানের শেষ দিন বিকেলবেলায় রমজানের আগমনী বার্তা ঘোষণা করে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সকলের সামনে রমজান ও সিয়ামের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য তুলে ধরেন। হযরত সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, কালা খাতাবানা হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফী আখিরি ইয়াওমিন্ মিন শা’বানা ফাকালা আইয়্যুহান্নাস। কাদ আজল্লাকুম শাহ্রুন্ আজীমুন মুবারাকুন, শাহ্রুন, ফীহি লায়লাতুন্ খায়রুম্ মিন্ আলফি শাহ্র, জা’আলাল্লাহু সিয়ামাহু ফারীদাতান ওয়া কিয়ামা লায়লিহী তাতাওউ’আন মান তার্কারাবা ফীহি বি খাসলাতিম্ মিনাল খায়রি কানা কামান আদদা ফারীদাতান ফীমা সিওয়াহু ওয়া মান্ আদ্দা ফারীদাতান ফীহি কানা কামান আদ্দা সাব’ঈনা ফারীদাতান ফীমা সিওয়াহু, ওয়া হুয়া শাহ্রুস সব্রি ওয়াস সব্রু সাওয়াবুহুল জান্নাত, ওয়া শাহ্রুল্ মুওয়াসাতি, ওয়া শাহ্রুন্ ইউযাদু ফীহি রিয্কুল মু’মিনি মান্ ফাত্তারা ফীহি সায়িমান কানা লাহু মাগফিরাতান্ লি যুনিবিহী ওয়া ইত্কা রকাবাতিহী মিনাননারি ওয়া কানা লাহু মসিলু আজরিহী মিন গায়রি আন্ ইয়ান্তাকিসা মিন আজরিহী শায়উন, কুল্না ইয়া রাসূলাল্লাহি লায়সা কুল্লুনা নাজিদু মা নুফাত্তিরু বিহিস সায়িমা ফাকালা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইউতিল্লাহু হাযা সওয়াবা মান ফাত্তরা সায়িমান আলা মাযকাহি লাবানিন্ আও তামরাতিন্ আওশুরবাতিন্ মিন মায়িন্ ওয়া মান আশরবা’আ সায়িমান সাকাহুল্লাহু মিন হাওদী রহমাতুন্ ওয়া আউসাতুহু মাগফিরাতুন্ ওয়া আখিরুহ ইত্কুম্ মিনান্নার, ওয়া মান্ খাফ্ফাফা আন মাম্লুকিহী ফীহি গাফারাল্লাহু লাহু ওয়া আ’তাকাহু মিনান্ নার।
অর্থাৎ শা’বান মাসের শেষ দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশে এক খুতবায় বললেন, হে মানুষ! তোমাদের ছায়া দিতে আবির্ভূত হচ্ছে মহান মুবারক মাস। এই মাসে রয়েছে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী। এ মাসের সিয়ামকে আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন, এর রাতে দÐায়মান হওয়াতে (তারাবির সালাত আদায়ে) রয়েছে সওয়াব। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করবে, সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করার সমান সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করবে। এটা ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। এটা সহমর্মিতার মাস। আর এটা হচ্ছে সেই মাস যাতে বৃদ্ধি করা হয় মুমিনের রিয্ক। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো সায়িমকে (রোজাদার) ইফতার করাবে সে ব্যক্তির জন্য তা গোনাহ মাফ পাবার এবং দোজখের আগুন থেকে মুক্তি পাবার হেতু হয়ে যাবে। এছাড়া তার সওয়াব হবে সেই সায়িমের সমান কিন্তু সায়িমের সওয়াব একটুও কমে যাবে না। আমরা (সাহাবায়ে কেরাম) জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে অনেকেরই সায়িমকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য নেই। তখন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, পেটভর্তি করে খাওয়াতে হবে এমনটা নয়, আল্লাহ তা’আলা তাকেই সওয়াব দান করবেন যে সায়িমকে এক চুমুক দুধ অথবা এক টুকরো খেজুর কিংবা এক ডোক পানি দ্বারা ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো সায়িমকে তৃপ্তির সাথে খাওয়াবে আল্লাহ তা’আলা তাকে আমার হাউদ (হাউজে কাওসার) থেকে পানি পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে দাখিল হওয়ার আগ পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না। এ এমন এক মাস যার প্রথমাংশ রহমতের, মধ্যাংশ মাগফিরাতের আর শেষাংশ দোজখের আগুন থেকে মুক্তির। আর যে ব্যক্তি এ মাসে চাকরবাকরদের (অধীনস্থ) কাজের ভার (বোঝা) লাঘব করে দেবে আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং দোজখ থেকে তাকে নাজাত দান করবেন। (বায়হাকী, মিশকাত শরীফ)।
রমজান মাসের প্রাক্কালে প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ঐ খুতবায় রমজান মাসের মাহাত্ম্য যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি এই মাসে যেসব বরকত ও প্রাচুর্য রয়েছে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন।
ঐ খুতবায় সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যের উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ধৈর্যের (সবর) প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। অন্য একখানি হাদিসে আছে যে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আস্ সিয়ামু জুন্নাতুন, ফালা ইয়ারফুস ওয়ালা ইয়াজহাল্ ওয়া ইন আমরূউন্ ফা আতালাহু আও শাতামাহু ফালইয়াকুল ইন্নি সায়িমুন র্মারাতায়নÑ সিয়াম হচ্ছে ঢাল। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ ঝগড়া করতে চায় কিংবা গালি দেয় তাহলে দুইবার বলতে হবে আমি সায়িম। (বুখারী শরীফ)।
এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঝগড়া-বিবাদ, পরনিন্দা, পরচর্চা, সন্ত্রাসী কর্মকাÐ, অশ্লীল কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার একটা মহা প্রশিক্ষণ রমজান মাসের সিয়াম পালন করার মধ্য দিয়ে লাভ হয়।
যদি কেউ লোক দেখানো সিয়াম রেখে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের পথ করে নেয়, যদি কেউ পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল দিয়ে মোটা অঙ্কের লাভ আদায় করতে চায়, যদি কেউ ওজনে কম দিয়ে লোককে ঠকায় তাহলে সে আদতে মুবারক মাস রমজানকেই কেবল অবজ্ঞা করে না, সে নিজে নিজেকেই যেন হত্যা করে, তাকে কোনো অবস্থাতেই মানুষ বলা যায় না।
মনে রাখতে হবে যে, রমজান মাসকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শাহ্ রুল মুওয়াসাত অর্থাৎ সহমর্মিতার মাস বলেছেন। এই মাসে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের প্রশিক্ষণ লাভ হয়। মানুষ মানুষের জন্যÑ এই যে কথা প্রায়ই বলা হয় সেটা সঠিকভাবে রপ্ত করে বাস্তবায়নের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়।
এ মাসেই প্রকৃতপক্ষে আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, সহিষ্ণুতা, মানবপ্রীতি ইত্যাদি গুণ অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ আসে। এ মাসেই কেবল একটি নফল অর্থাৎ ঐচ্ছিক কোনো ইবাদত কিংবা ভালো কাজ করলে তার সেই ঐচ্ছিকটা অন্য মাসের বাধ্যতামূলক কাজের সওয়াব লাভের সমান হয়ে যায়।
রমজানের সিয়াম সম্পর্কে একখানি অতিগুরুত্বপূর্ণ হাদিসে কুদসী রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : সে (সায়িম) আমার জন্য তার খাওয়া-দাওয়া, পানীয় পান, কামাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করে, সিয়াম আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (বুখারী শরীফ)। অন্য একখানি হাদিসে আছে যে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মমজান মাসের প্রথম রাত আসে তখন একজন আহŸানকারী আহŸান করেন, ইয়া বাগিইয়াল খায়রি আকবিল (হে কল্যাণকামী এগিয়ে যাও), ইয়া বাগিইয়াল শাররি আকসির (হে মন্দান্বেষী স্তব্ধ হও)! (তিরমিযী শরীফ)।
রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করার কথা মুখে বা ব্যানারে লিখে কিংবা মিছিলে ¯েøাগান তুলে বললে হবে না এটার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সর্বস্তরের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
রমজানের বিধান যে সকল আয়াতে কারীমায় রয়েছে তার প্রথম আয়াতেই ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। এই তাকওয়ার মধ্যেই তাবত্ পাপমুক্ত এবং অতিলোভমুক্ত সংযমী জীবনের মর্ম নিহিত রয়েছে। আর সেই তাকওয়া অর্জন করার জন্যই আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু রমজান মাসের সিয়ামকে ফরজ করে দিয়েছেন। এই একটি মাস কুরআন হাদিসের নির্দেশ অনুযায়ী যথাযথভাবে অতিবাহিত করতে পারলে বছরের বাকি এগারোটা মাস সুন্দর হয়ে উঠবে ইন্শাআল্লাহ।
লেখক : মুফাসসিরে কুরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন