আজ মহাচীনের প্রেসিডেন্ট শিন জিন পিং ঢাকায় শুভ পদার্পণ করছেন। ৩০ বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট লি জিয়ান লিয়ান বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ৩০ বছর পর বর্তমান সফরটি ঘটতে চলেছে। আমরা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে গণচীনের মহামান্য প্রেসিডেন্টকে জানাই আন্তরিক খোশ আমদেদ। বিগত ৩০ বছরে হোয়াং হো নদী আর বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। গণচীন পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থিত হয়েছে। অর্থনীতির জগতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ওপরে উঠে এসেছে। নিজের অর্থনৈতিক উত্থানের সাথে সাথে দেশটি পৃথিবী জুড়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন পার্টনার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এই ভূমিকা রাখতে গিয়ে চীন এসব দেশে অর্থনৈতিক সাহায্যের বিশাল প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে আসছে। এই বিশাল প্যাকেজে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য থাকছে অবকাঠামো, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ, শিল্প, পরিষেবা প্রভৃতি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে। পাক-চীন অর্থনৈতিক করিডোর নামে চীন নিজ দেশ থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি বিশাল সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে। এই সড়কটির দৈর্ঘ্য হল ১৫১৭ মাইল। এটি চীনের জিন জিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে শুরু করে আজাদ কাশ্মীর হয়ে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ইতোমধ্যেই ইরান ও সউদী আরব এই মহাসড়কের সাথে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যদি এই দু’টি দেশ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সাথে সংযুক্ত হয় তাহলে এই মহাসড়কটি চীন থেকে শুরু করে সউদী আরব পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন আরেকটি অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এটির নাম হবে বিসিআইএম। চীনের প্রেসিডেন্ট শিন জিন পিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফরে বাংলাদেশ, চীন-ভারত ও মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোরের বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য চিহ্নিত দুই হাজার ৮০০ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৭৫০ মাইল সড়ক পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের বেনাপোল-ঢাকা-সিলেট হয়ে আবার শিলচর দিয়ে ভারতের আসামে প্রবেশ করবে। এরপর মনিপুরের ইমফল হয়ে ভারত-নির্মিত তামু-কালিওয়া মৈত্রী সড়ক দিয়ে মিয়ানমার যাবে। মিয়ানমারের মান্দালয় হয়ে সড়কটি চীনের কুনমিংয়ে গিয়ে শেষ হবে। চীন ও মিয়ানমার হয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিসিআইএম করিডোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
চীন বিগত তিন বছর ধরে ‘ওয়ান ট্রেড রোড’ অর্থাৎ বাণিজ্যের জন্য একটি রাস্তা নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতদুদ্দেশ্যে এই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ইতিমধ্যেই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য দেশটি ১৩৮.৪ বিলিয়ন ডলার প্রকল্প ঘোষণা করেছে। এই ১৩৮.৪ বিলিয়নের মধ্যে রয়েছে (১) কাজাখস্তান-৫৩ বিলিয়ন (২) পাকিস্তান-৪৬ বিলিয়ন (৩) ভারত-২০ বিলিয়ন (৪) উজবেকিস্তান-১৫ বিলিয়ন (৫) কিরঘিজিস্তান-৩ বিলিয়ন (৬) শ্রীলঙ্কা-১.৪ বিলিয়ন। সবগুলোই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের আওতায়। এসব রাস্তা সংযুক্তভাবে অভিহিত হবে সিল্ক রুট নামে। এগুলো ছাড়াও এই রাস্তা যখন ইরান হয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত যাবে তখন সেখানে সংযুক্ত থাকবে ৬০টি দেশ। চীনের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সড়ক নির্মাণ খাতে ২০০ বিলিয়ন ডলার এবং বিভিন্ন প্রকল্প খাতে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশী টাকায় ৮ লক্ষ কোটি টাকার সমান। (এখানে ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছে ৮০ টাকা)। অদূর ভবিষ্যতে তার এই অকল্পনীয় বিশাল বিনিয়োগে বাংলাদেশের যেন একটি বড় হিস্যা থাকে সে জন্য বাংলাদেশকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, এই সফরকালে চীন বাংলাদেশকে ৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ২৫টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। পক্ষান্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্টের আসন্ন সফরকালে বাংলাদেশ যে সব প্রকল্প পেশ করবে সেগুলোর জন্য চলতি বাজার মূল্যে ব্যয় হবে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য, ভারত এ পর্যন্ত যে সাহায্য বাংলাদেশকে দিয়েছে তা ২ বিলিয়নের বেশি হবে না। অথচ ভারতের এমন কোনো চাহিদা নাই যা বাংলাদেশ পূরণ করেনি। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কি পেয়েছে? দু’বছরের ওপর হল, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেছেন। অথচ তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানের কোনো আলামত নাই।
চীনের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সু-সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সমর সম্ভারের সিংহভাগ সংগ্রহ করা হয়েছে চীন থেকে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর যাত্রা শুরু হয় রুশ ট্যাংক এবং রুশ জঙ্গি বিমান দিয়ে। এখন বিমান বাহিনীর মেরুদ- হল চীনা জঙ্গী বিমান। নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট দিচ্ছে চীন। চীন থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিনও ক্রয় করছে। সেনাবাহিনীর ট্যাংক সমূহেরও সিংহ ভাগ চীনের। চীন যখন কোনো দেশকে অস্ত্র সরবরাহ করে তখন আমেরিকার মত একগাদা শর্ত আরোপ করে না। চীন সাহায্য করছে ঠিকই, কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশে যে আধুনিক ও শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সেই রকম বড় বা শক্তিশালী নয়। আমাদের জঙ্গি বিমান বহরে ২০০টি জঙ্গি বিমানও নাই। প্রয়োজন পূরণের মত ডেষ্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন, ট্যাংক ইত্যাদি সরবরাহ করার উদারতা আছে চীনের। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হবে, ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা তত কমবে। অনেকে বলেন যে, বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে আছে বিশাল ভারত। সেই ভারতের প্রভাব মুক্ত হওয়া কি সম্ভব? যারা এই ধরনের যুক্তি দেন তারা সম্ভবত কিউবার কথা ভুলে যান। বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি বিশাল আমেরিকা। মানচিত্রের দিকে তাকান, দেখবেন, সাহিত্যের ভাষায়, আমেরিকার পদতলে কিউবা। কিউবাকে আমেরিকা ইচ্ছা করলেই হা করে গিলে খেতে পারত। কিন্তু পারে নাই। কারণ, কিউবার পেছনে রয়েছে আরেক মহাশক্তি সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং বর্তমান রাশিয়া। ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে কিউবা আক্রমণ করে দেশটিকে গ্রাস করার চেষ্টা করে আমেরিকা। আমেরিকার যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের আণবিক অস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ মার্কিন সামরিক শক্তির মোকাবেলায় পিগ উপসাগর অভিমুখে রওনা হয়। তখন আমেরিকা পিছু হটে। এভাবে পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। চীন বাংলাদেশের অত্যন্ত নিকট প্রতিবেশী। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। তাই আজ যদি চীনের সাথে বাংলাদেশের সেইরকম ঘনিষ্ঠতা থাকত তাহলে ভারতের ওপর বাংলাদেশকে এককভাবে নির্ভর করতে হতো না। পেছনে যদি চীনের সেইরকম সমর্থন থাকত তাহলে প্রতিবেশী নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাও আপদে বিপদে বাংলাদেশের পাশে থাকত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন