বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শবে বরাত

ইয়াছিন মজুমদার | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আরবী শাবান মাসের পরেই আসে রমজান। রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে তাই শা’বান মাসের গুরুত্ব রয়েছে। হাদিস শরীফে নিসফে মিন শাবান তথা শাবানের অর্ধাংশের রজনী অর্থাৎ ১৫ তারিখের রজনী, যাকে ভারতীয় উপমহাদেশসহ কিছু মুসলিম দেশে শবেবরাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তার গুরুত্ব বর্ণনায় উন্মুল মুমেনিন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)কে শাবান মাসের মতো এত অধিক সাওম পালন করতে আর কোনো মাসে দেখিনি (বুখারী ও মুসলিম)। রমজানের প্রস্তুতি ও সাওয়াব লাভের জন্য নবী (সা.) শাবান মাসে বেশি নফল রোজা রাখতেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নবী (সা.) বলেন: এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের আমল উঠানো হয়। আমি ভালোবাসি যে রোজা রাখা অবস্থায় আমার আমল আল্লাহর নিকট উঠানো হোক (নাসাই)। নবী (সা.) আরো বলেন: আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাতে তার সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন (ইবনু মাজাহ)। এ হাদিসটি ৮ জন সাহাবীর সূত্রে সহীহভাবে বর্ণিত। এ হাদিসের আলোকে বলা যায়, যে রাতে আল্লাহ বান্দার দিকে দৃষ্টিপাত করেন, ক্ষমা করে দেন সে রাত্রিটি ইবাদতে অতিবাহিত করার গুরুত্ব রয়েছে।

অর্ধ শাবান মাসের ইবাদত ও ফযিলত সম্পর্কে নবী (সা.) বলেছেন: যখন শাবান মাসের অর্ধ রাত্রির আগমন ঘটে তোমরা দিনে রোযা রাখবে এবং রাতে ইবাদতে দন্ডায়মান হবে। কেননা, অর্ধ-শাবানের রাত্রিতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহপাক দুনিয়ার আকাশে (১ম আকাশে) অবতরণ করে ঘোষণা করেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? থাকলে আমি ক্ষমা করে দেব, কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক বাড়িয়ে দেব, কোনো অপরাধী আছ কি? আমি অপরাধ মুছে দেব। এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে প্রার্থনার ঘোষণা দিতে থাকেন। এ ঘোষণা ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে (ইবনু মাজাহ)। আরবে রবি গোত্র, কালব গোত্র ও মদর গোত্র পশুর সংখ্যাধিক্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এক রাতে হযরত আয়েশা (রা.) ঘুম থেকে উঠে নবী (সা.)কে বিছানায় না দেখে খুঁজতে বের হলেন এবং জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে দেখতে পেলেন। নবী (সা.) বললেন, এ রাতে আল্লাহ নি¤œ আকাশে নেমে আসেন এবং কলব গোত্র, রবী গোত্র, মদর গোত্রের পশুসমূহের পশমের সংখ্যক পাপী উম্মতের উপর দয়া প্রদর্শন করেন (তিরমীযি)। আরেক বর্ণনায় দেখা যায় নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শাবান মাসে তিনটি রোযা রাখবে আল্লাহপাক তার জন্য কেয়ামতের দিন বাহন হিসেবে জান্নাতের একটি উটনী দেবেন (ইবনে নাবাতা)।

আলা ইবনে হারীস থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একরাতে নবী (সা.) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদা এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ভাবলাম নবী (সা.) ইনতেকাল করেছেন। আমি উঠে নবী (সা.) এর বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল, আমি চলে এলাম। সালাত শেষে নবী (সা.) বললেন, হে হুমায়রা তুমি কি মনে করেছ নবী (সা.) তোমার সাথে বিশ^াসভঙ্গ করেছেন? আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি তা মনে করিনি, বরং মনে করেছি আপনি না জানি ইনতেকাল করেছেন। তিনি বললেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটা মধ্য শাবানের রাত, এ রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করেন, রহমত প্রার্থনাকারীকে রহম করেন, হিংসুকদের তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন (শুয়াবুল ঈমান)।

উল্লেখিত বর্ণনার আলোকে শবে বরাতে আমরা আমল করতে পারি। তবে নবী (সা.) নিজে ঘরে ইবাদত করলেও মসজিদে সমবেত হয়ে একত্রে ইবাদত করতে বা অন্য কাউকে এ রাতে ইবাদত করতে নির্দেশ দেননি এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকেও এ ধরনের কোনো ইবাদত করা প্রমাণিত নেই। নবী (সা.) ফরয নামাজ মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করার জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সুন্নত নফল ঘরে আদায় করাকে উত্তম বলেছেন। নফল ইবাদত প্রকাশ্যে করলে লোক দেখানোর সুযোগ থাকে অর্থাৎ এতে রিয়ার সুযোগ হয়। তাই নফল ইবাদত নিরিবিলি ঘরে আদায় করাই উত্তম। ভারতীয় উপমহাদেশসহ কতিপয় দেশে শবে বরাতে মসজিদে সমবেত হয়ে ইবাদত করার প্রচলন করা হয়েছে। তবে আল্লাহর প্রেমিক বান্দাহদের শুধু মাত্র শবে বরাত ও শবে কদরের প্রচলিত ইবদাতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়।

বোখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখিত বিশুদ্ধ হাদিসে দেখা যায়, নবী (সা.) বলেছেন: আল্লাহপাক প্রত্যেক রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয়ে ঘোষণা করেন, আমি রাজাধিরাজ, আমি রাজাধিরাজ, যে আমাকে আহŸান করবে আমি সাড়া দেব, যে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি প্রদান করব, যে ক্ষমা চাইবে আমি ক্ষমা করব এভাবে ফজর উদয় পর্যন্ত ঘোষণা করা হতে থাকে। উক্ত হাদিসের আলোকে উচিত শুধু শবে বরাত, শবে কদরের প্রচলিত ইবাদতের পাশাপাশি তাহাজ্জুদের নামাজে নিয়মিত হওয়া ও রাত্রিকালীন প্রার্থনায় অভ্যস্থ হওয়া আবশ্যক।

প্রত্যেক মাসের মধ্যবর্তী তিনদিন রোজা রাখার গুরুত্ব রয়েছে, যাকে আইয়ামে বীজের রোজা বলা হয়। অনেকে এ রাতে আলোক সজ্জা বা হালুয়া রুটি ইত্যাদিকে এবং সন্ধ্যায় গোসল করাকে অনেক পুণ্যের মনে করে, যার কোনো ভিত্তি নেই। অপর দিকে অনেকে আতশ বাজি ও পটকা ফোটায়, যা এ রাত্রির পবিত্রতাকে বিনষ্ট করে। আমাদের ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য, যেমন মাওলানা রুমী জঙ্গলে রাত নিশিথে কেঁদে কেঁদে বলতেন, রাত্রি নিশিতে যখন কাঁদি আকাশ ছাড়া কেউ থাকে না, আমার কাঁদার ভেদের কথা খোদা ছাড়া কেউ জানে না।
লেখক: অধ্যক্ষ ফুলগাঁও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন