শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মহিমান্বিত শবে বরাত এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আমল

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০২২, ১২:১৪ এএম

কোরআনে সূরা বাকারায় বলা হয়েছে: ‘রমযান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন।’ (আয়াত: ১৮৫)। অপরদিকে সূরা কদরে বলা হয়েছে: ‘আমি একে নাযিল করেছি, শবে কদরে’ (আয়াতে: ১)। সূরা দোখানে বলা হয়েছে: আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাত্রে’ (আয়াত: ৩)।
বর্ণিত ৩নং আয়াত ‘বরকতময় রাতে’ (লাইলাতুন মোবারাকা) এই বাক্যকে কেন্দ্র করে শবেবরাত নিয়ে বিতর্কের সূচনা এবং শবেবরাত সম্পর্কে কিছু দুর্বল হাদীস এ বির্তককে আরো চাঙ্গা করেছে। তাছাড়া শবেবরাত উপলক্ষে প্রচলিত নানা কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, সামাজিক জীবনে বহু কু-প্রভাবের জন্ম দিয়েছে। ফলে ধর্মীয় দিক থেকে শবেবরাতের মাহাত্ম্য-মর্যাদা বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিষয়টি নিয়ে তাই আলোচনা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমে মোহাদ্দেসীনে কেরামের একটি স্বীকৃত নীতি উল্লেখ করা আবশ্যক মনে করি। তা হলো, যে সব হাদীসের দ্বারা কোনো কাজের বৈধতা প্রমাণিত হয়, সে কাজ করা মোস্তাহাব- উত্তম। ইমাম আওযায়ীও এ মত পোষণ করেন। শবেবরাতের ফজিলত সংক্রান্ত প্রচলিত হাদীসগুলো যদি এ মাপকাঠির ভিত্তিতেও বিচার করা যায়, তাতেও শবেবরাতের মর্যাদা সর্ম্পকে সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ থাকে না। তাছাড়াও এ কথাও স্মরণযোগ্য যে, শবেবরাত সম্পর্কে বোখারী-মুসলিমে কোনো হাদীস বর্ণিত না হলে, এ সম্পর্কে অপর কোন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, এরূপ যুক্তি কেউ প্রদর্শন করলে তাও বাতিল বলে গণ্য হবে। তাই আমরা শবেবরাতের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে এখানে কয়েকটি হাদীসের অর্থ উল্লেখ করতে চাই, যেগুলো মোহদ্দেসীনের নিকট সহি-শুদ্ধ। এসব বর্ণনায় শবেবরাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও হুজুর (সা.) এর আমলও জানা যাবে। হজরত ইকরিমা (রা.) এবং তাবেঈগণের মধ্যে খালেদ ইবনে মা’দান মাকহুল ও লোকমান ইবনে আমের প্রমুখ শবেবরাতের বৈধতার পক্ষে বলেছেন। পক্ষান্তরে আতা ও ইবনে আবি প্রমুখ এতে দ্বিমত পোষণ করেন। শাফেয়ী ও মালেকী উলামার মতও শবেকদরের পক্ষে।
হযরত আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী লিখেছেন, খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের এবং ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াই মসজিদে সমবেত হয়ে এ রাতে জাগ্রত থাকতেন। খালেদ ও লোকমানের অবস্থা ছিল এই যে, শাবানের পঞ্চদশ রাতে এ দুজন উত্তম পোশাক পরিধান করতেন, সুরমা ব্যবহার করতেন এবং সারারাত মসজিদে এবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকতেন। সুতরাং যে ব্যক্তি শাবানের পঞ্চদশ রাতে জাগ্রত থেকে (এবাদতে) রাত কাটায়, বিভিন্ন হাদীস অনুযায়ী তা হবে সম্পূর্ণ মোস্তাহাব বা উত্তম কাজ।
আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী বলেন, বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায় যে, সেটি পনেরো শাবানের রাত, যাকে শবে বরাত বলা হয়। সম্ভবত সেখান হতে (লৌহ মাহফুজ হতে আল্লাহর ফায়সালাসমূহ) এ কাজের সূচনা করা হয় এবং শবেকদরে শেষ হয় । অর্থাৎ শবেবরাতে শুরু হয় এবং শবেকদরে শেষ হয়।
শবেবরাত তাৎপর্য মন্ডিত ও মহিমান্বিত হওয়ার এবং এ রাতে হুজুর (সা.) এর আমলের বিষয় উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা (রা.) এর জবানী জানা যেতে পারে। শবেবরাতে হুজুর (সা.) মুসলমান নারী-পুরুষ ও শহীদদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে কবরস্থানে গমন করেছিলেন। এ সর্ম্পকে হযরত আয়েশা (রা.) যা বর্ণনা করেন তা নি¤œরূপ: ‘এক রজনীতে রসুলুল্লাহ (সা.) আমার কক্ষে আগমন করেন এবং পোশাক খুলতে আরম্ভ করেন কিন্তু সম্পূর্ণ খোলার আগেই আবার পরিধান করেন। এতে আমার খুবই ঈর্ষা হয় এবং ধারণা হয় যে, তিনি আমার কোনো সতীনের কক্ষে গমন করছেন। তাঁর যাত্রা করার পর আমি তাঁর পেছনে পেছনে চলতে থাকি। আমি দেখলাম, তিনি বিখ্যাত কবরস্থান ‘বাকীয়ে গরকদে’ মুসলমান নারী-পুরুষ ও শহীদদের মাগফিরাতের জন্য দো’আ করছেন। তাঁকে এ অবস্থায় দেখে আমি মনে মনে বললাম, আমার পিতা-মাতা তাঁর জন্য কোরবান হোন, তিনি আল্লাহর কাজে লিপ্ত, আর আমি দুনিয়াবী কাজে লেগে আছি। অতঃপর আমি নিজের কক্ষে চলে আসি। তখন আমার দীর্ঘশ্বাস নির্গত হচ্ছিল; এমতাবস্থায় তিনিও প্রত্যাবর্তন করেন এবং আমাকে হাঁপাতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আয়েশা! কী ব্যাপার, হাঁপাচ্ছ কেন? আমি বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক। আপনি এসে পোশাক ছাড়াচ্ছিলেন এবং তা শেষ না হতেই আবার দাঁড়িয়ে পুনরায় পোশাক পরলেন। এতে আমার ঈর্ষা হয় এবং আমার ধারণা হয় যে, আপনি আপনার অপর কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করছেন। শেষ পর্যন্ত আপনাকে আমি বাকী কবরস্থানে দো’আরত দেখলাম। এরপর তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি ভয় করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.) তোমার প্রতি কোনো জুলুম-অন্যায় করবেন?’
‘ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, জিবরাইল (আ.) আগমন করেন এবং বলেন, আজ শাবান মাসের পনেরোতম রাত। এতে আল্লাহ তা’আলা বনু কলবের বকরিগুলোর কেশের সমপরিমাণ তাঁর বান্দাদের মাগফিরাত (ক্ষমা) করেন কিন্তু ক্ষমা করেন না নি¤েœাক্ত কয়েক শ্রেণীর লোককে। তারা হচ্ছে: মোশরেক, হিংসুটে, আত্মীয় সম্পর্ক ছিন্নকারী, দুর্ব্যবহারকারী, অহংকারী, পোশাক ছেচঁড়ে (গোড়ালী নিচে) চলাচলকারী, পিতামাতার অবাধ্য এবং সর্বদা মদখোরদের। অর্থাৎ এদের প্রতি করুণার দৃষ্টিপাত করবেন না। অতঃপর তিনি পোশাক খুলেন এবং বলেন: হে আয়েশা! আজ রাত জাগ্রত থাকার অনুমতি আছে কি? আমি বললাম, জ্বী হ্যাঁ! আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কোরবান হোন। আপনি সানন্দে রাত জেগে এবাদত করুন। সুতরাং তিনি এবাদত বন্দেগীর জন্যে দাঁড়িয়ে যান। নামাজে তিনি দীর্ঘ সেজদায়রত থাকেন, তাতে আমার আশংকা হলো তাঁর প্রাণের স্পন্দন আছে কি’না। আমি উঠে গিয়ে তাঁকে যাচাই করতে থাকি, আমি তাঁর পায়ের তালুতে হাত দিয়ে দেখি, রক্ত চলাচল ঠিক আছে। এতে আমি আনন্দিত হলাম এবং তাঁকে সেজদারত অবস্থায় এই দো’আ করতে শুনি: হে আল্লাহ! আমি তোমার ক্ষমা অনুগ্রহ লাভের জন্য তোমার পাকড়াও হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য তোমার অসন্তুষ্টি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! তোমার জালাল ও জামালের শপথ, তোমারই আশ্রয়দান প্রার্থনা করছি এবং আমার পক্ষে তোমার হামদ্-সানা (যথাযথ প্রশংসা) সম্ভব নয়, তুমি যেমন তোমার প্রশংসা করেছো। ভোরে আমি (আয়েশা) হুজুর (সা.)কে তাঁর দো’আগুলোর কথা উল্লেখ করি। তিনি বললেন, এসব দো’আ মুখস্ত করবে এবং অন্যানদেরও এগুলো শেখাবে। কেননা জিবরাইল (আ.) আমাকে এসব দো’আ শিক্ষা দিয়েছেন এবং বলেছেন, সেজদায় এসব দো’আ বারবার পড়বে।’ (বায়হাকী)
একই সূত্রে একই গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত আকারে আরেকটি বর্ণনাও রয়েছে, যাতে হযরত আয়েশা (রা.)কে ‘হোমায়রা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ইমাম বায়হাকীর নিয়ম হলো, কোনো হাদীসের সনদ দুর্বল হলে তিনি তা উল্লেখ করেন কিন্তু বর্ণিত দুটি বর্ণনার একটিতেও দোষবাচক কোনো শব্দের উল্লেখ নেই। সুতরাং উল্লেখিত দীর্ঘ হাদীসের মর্ম সম্পর্কে কোনো আপত্তি থাকারও কথা নয়।
উল্লেখিত মর্মের হাদীসটি বায়হাকী ছাড়াও ইবনে মাজা এবং ইবনে আবি-শায়বা হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন বলে হযরত আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী উল্লেখ করেছেন। ইমাম বায়হাকী উসমান ইবনে আসের মাধ্যমে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এর জবানী বর্ণনা করেছেন যে, শাবানের পনেরোতম রাতে আহŸান করা হয়: মাগফিরাত প্রত্যাশী কেউ আছে কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো, কোনো প্রশ্নকারী আছে কি, আমি তার আশা পূরণ করে দেবো। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক প্রশ্নকারীর দো’আ কবুল করেন এবং ব্যাভিচারিনী নারী ও মোশরেকের কোনো দো’আ-ই শ্রবণ করেন না। শবে বরাতে নির্দিষ্ট রাকাতে নামাজ পড়া সংক্রান্ত হাদীসগুলো উল্লেখ করে সেগুলোকে ‘মওযু’ বা জাল হাদীস বলে মোহাদ্দেস দেহলভী সাহেব উল্লেখ করেছেন।
ইবনে মাজা ও বায়হাকী হযরত আলী (রা.) এর জবানী রসূলুল্লাহ (সা.) এর এ ফরমান লিখেছেন যে, পনেরোতম শাবানের রাতে জাগ্রত থাকো এবং পরের দিন রোজা রাখো । কেননা এ রাতে আল্লাহ তা’আলা মাগরিবের সময় থেকেই দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কেউ আছে কি আমার কাছে মাগফিরাত কামনা করবে, যাতে আমি তার মাগফিরাত করবো, জীবিকা তলবকারী কেউ আছে কি, যাকে আমি অফুরন্ত জীবিকা দান করবো, কেউ কি বিপদগ্রস্ত আছে, পরকালীন কল্যাণকামী কেউ আছে কি, যাকে আমি তা দান করবো। এভাবে ফজর তুলু (উদিত) হওয়া পর্যন্ত আল্লাহতা’আলা জিজ্ঞাসা করতে থাকেন।
উপরোক্ত বর্ণনায় শবেবরাতের বৈশিষ্ট্য, তাৎপর্য এবং রসুলুলালাহ (সা.) এর আমল ইত্যাদি সম্পর্কে জানা গেলো। এ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের জন্য দো’আ করার প্রমাণ এবং রাতে এবাদত ও পরের দিন রোজা রাখার কথাও জানা গেলো।
হযরত আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী তার সময়ে ভারতে প্রচলিত শবেবরাতের কুসংস্কারগুলোর বিবরণ দিয়েছেন। বর্তমানে আমাদের দেশেও সেগুলোর অধিকাংশ এবং আরো নতুন নতুন কুসংস্কার শবেবরাতের মর্যাদা ক্ষুণœ করে চলছে। মুসলমানদের উচিত শবেবরাতে প্রচলিত সমস্ত কুসংস্কার বর্জন এবং এ মহিমান্বিত রজনীর ধর্মীয় মর্যাদা গাম্ভীর্য অক্ষুণœ রাখা ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন