রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাগলা হওয়া

প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:০৮ পিএম, ১২ নভেম্বর, ২০১৬

ফাহিম ফিরোজ


বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ এই পৃথিবী
ছেড়ে গেলেও তার বৈচিত্র্যময় অমর সাহিত্য সম্ভার পাঠককে আজও
আলোড়িত করে। আজও মুগ্ধতার বেড়াজালে আটকে রাখে।
আজ হুমায়ূন আহমেদের ৬৮ তম জন্মদিন
বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন হতে দেখা যায় দুই পর্যায়ে। এক. মৃত্যুর আগে ২. মৃত্যুর পরে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর আগেই খ্যাতির সর্ব শেষ চূড়া স্পর্শ করেছিলেন। এটা একজন লেখকের জন্য সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। হুমায়ূনের জন্য এ কাজটা সম্ভবত সহজ হয়েছিল তিনটি আমোঘ কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে- তিনি ছিলেন মেধাবি। দ্বিতীয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক, তৃতীয় কারণ, রাজনৈতিকভাবে কোথাও শক্তপোক্তভাবে লেগে না থাকা। হুমায়ূন ভক্তদের দেখা যায়, তাদের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পড়–য়া মহলে তার প্রবেশ করা বেশ সহজসাধ্য বিষয় ছিল। এসব পড়–য়ারাই নানাভাবে, নানা দিকে এই মহান লেখকের সৃষ্টি সম্ভার পৌঁছে দিয়েছে পাঠাকের কাছে। এসব পড়ুয়ারা বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকার অর্থ হচ্ছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া। হুমায়ূন আমমেদ এ কাজটি অন্তত করেননি। আমাদের দেশের লেখকরা এখন বাম ও ডাম দু’ভাবে বিভক্ত। এক পক্ষের লেখকরা অন্য পক্ষের লেখা পড়েন কিন্তু কোনো মন্তব্য করেন না। রাজনৈতিক পাল্লা যেদিকে ভাড়ি সেদিকে ভিড়তে চায় আরেকটি সুবিধাবাদী গ্রুপ। যারা পক্ষ বিচার করে পত্রপত্রিকায় লেখকদের লেখা ছাপেন, এরাই হল আমাদের সাহিত্যের বড় শত্রু।
আমার জানা মতে এ দেশের এমন কিছু প্রতিভাবান লেখক আছেন যারা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক ব্লকে নেই কিন্তু মিডিয়ার লেখা ছাপাতে পারছেন না। কারণটা আগেই বলেছি। এসব লেখকদের লেখার মানদ- কোনোক্রমেই রাজনৈতিকবাদী লেখকদের থেকে কম নয়। একদল লিখছে বোদলেয়ার- জীবনানন্দ ধর্মী লেখা, অন্য দল লিখছে ফররুখ-আল মাহমুদ ঢঙ্গীয় লেখা। আর একটি শক্তিশালী লেখক গ্রুপ আছেন, যারা এদের এড়িয়ে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন। এদের লক্ষ্য রাজনীতি না। যারা দুই ধারাকেই এড়িয়ে নীরবে নিভৃত্তে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন, এরাই মূলত প্রকৃত মৌলিক লেখক। এরা জেগে উঠলে ওসব রাজনৈতিক লেখকরা মোমের আলোর মত ফুৎকারে নিভে যাবে। এটা তারা নিজেরাও জানেন। তবুও ফন্দিফিকির করে সাহিত্যে বেঁচে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে সুখকর। তিনি যেভাবে গল্পে, উপন্যাসে এবং নাটকে তার কথা বলতে চেয়েছেন তার সমকালীন লেখকরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা ব্যর্থ হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন। এর উত্তরে বলা যায় প্রতিভার তারতম্য। প্রতিভা শব্দের ব্যাখ্যা অনেকেই অনেকভাবে দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা পাঠকদের কাছে যুঁতসই মনে হতে পারে। যেমন ধরা যাক, দশতলা একটি ভবন। মাটি থেকে ওই ভবনের ছাদে আপনাকে উঠতে হবে কোনো রকম সিঁড়ি ও মই বা দড়ি ছাড়া। অপ্রতিভাবানরা এ ক্ষেত্রে কিন্তু মহাবিপাকে ঘোরপাক খাবেন কিন্তু যারা প্রতিভাবান তারা ঠিকই বায়ুভর্তি বেলুন চেপে ঐ স্থানে পৌঁছে যাবেন। হ্যাঁ, পাঠক হুমায়ূন আহমেদ সেই রকমই এক প্রতিভা যাকে চলার পথে স্ক্রাচে বা কারো ঘাড়ে চড়ে পথ চলতে হয়নি। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিভাই তাকে আজ বাংলা কথাসাহিত্যে জনপ্রিয়তা শ্রেষ্ঠ আসনটি দান করেছে। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা সেই পাগলা হাওয়ার ঢেউ আজো আমাকে আলোড়িত করে, বিমোহিত করে। বিষয়টা একটু খোলসা করেই বলি। তখন গত শতকের নব্বই সালের শেষের দিক। সাপ্তাহিত পূর্ণিমার পক্ষ থেকে বই মেলায় হুমায়ূন আহমেদের উপর রিপোর্ট করার দায়িত্ব পেয়ে বই মেলায় যথারীতি হুমায়ূন আহমেদের পাশেই বসে পড়ি। তাকিয়ে দেখি, চারদিকে তাকে রক্ষার জন্য অনেক ভলেনটিয়ার। এমন সময় এদের মধ্য থেকে একজন এসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানায়- স্যার, ওপার বাংলার ঔপন্যাসিক শীর্ষশেন্দু বাবু এসেছেন আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। হুমায়ূন আহমেদ তখন বসে আছেন এবং ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতে ঘর্মাক্ত। তিনি স্বাভাবিক কিন্তু শৌল্পিকভাবে উত্তর দেন- ‘আমি কি করবো। তোমরা তো দেখতেই পারছো।’ ‘হ্যাঁ, আমরা দেখলাম তার জনপ্রিয়তার সেই পাগলা হাওয়া। যা উড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ-ভারতের সকল লেখক প্রতিভাকে। এ ঘটনা দু’দিন আগে তার উপরে রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি বাংলা একাডেমির মূল ফটকে হুমায়ূন ভক্তদের চাপে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিলাম প্রায়। শেষে তারেক নামে সেই সময়ের আমার এক বন্ধু (যে এখন টিভি নাটকে অভিনয় করে) আমাকে মাটি থেকে ওর ঘাড়ে তুলে পূর্বদিকে উদ্যানে নিয়ে যায়। এবং আমি পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকলে অনেক কষ্টে সে পানি না পেয়ে এক গ্লাস তাড়ি আমার মুখে ঢেলে জীবন বাঁচায়। ওহ সে কি দুর্গন্ধ! এ জন্য ঐদিনের ঘটনাটা আমার সমগ্র জীবনের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে আছে।
আজ হুমায়ূন আহমেদ নেই কিন্তু বেঁচে আছে তার অমর সৃষ্টিসম্ভার। হুমায়ূন আহমেদ নেই তাই বই মেলায় এখন আর কারো পাঠকদের চাপে মরার ভয়ও নেই। হ্যাঁ... হ্যাঁÑ এই তো আমাদের হুমায়ূন আহমেদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন