বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের মধ্যে সৌন্দর্য সচেতনতা অনেক বেড়েছে বলে চিকিৎসকরা বলছেন। একারণে তাদের সৌন্দর্য চর্চা শুধুমাত্রা নানা উপকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তাদের অনেকে জন্ম থেকে শরীরের কোনো খুঁত সারাতেও শল্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
বাংলাদেশের চিকিৎসকরা বলছেন, এখন নারী ও পুরুষ- উভয়েই তাদের শারীরিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে নানারকম পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছেন। এক সময় এসব চিকিৎসার সুযোগ বাংলাদেশে না থাকলেও এখন দেশেই এসব সেবা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য শরীরে অস্ত্রোপচার করলে বা কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিবর্তন করা হলে তাতে কি শরীরে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে?
প্লাস্টিক সার্জারি হলো- শরীরের কোনো একটি অংশ এমনভাবে ঠিক করা যাতে সেই অংশে কোনো ক্ষত বা ক্রুটি থাকলে সেটা সংশোধন করা যায়। এই প্লাস্টিক সার্জারির দুটি অংশ হচ্ছে- কসমেটিক ও অ্যাসথেটিক সার্জারি। গ্রীনলাইফ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের অ্যাসথেটিক প্লাস্টিক সার্জন ডা. তাসলিমা সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, প্রধানত মেয়েরা তাদের কাছে আসছেন। শুধুমাত্র ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে, বিভিন্ন শ্রেণির নারীরা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য চিকিৎসকদের কাছে আসছেন।
''প্রেগনেন্সির পরে দেহে যে পরিবর্তন আসে, সেটার কারণে হয়তো দেখতে বেশি ভালো লাগছে না বা অনেক কাপড় পরতে পারছেন না, ব্রেস্ট হয়তো একটু ঝুলে গেছে, পেটে হয়তো অতিরিক্ত চর্বি জমে গেছে- এসব কনসার্ন নিয়ে তারা আমাদের কাছে আসছে,'' বলছেন ড. সুলতানা। সাধারণত স্তন বা পেটের অতিরিক্ত চর্বি সরিয়ে ছোট করা হয়। আবার সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট বসিয়ে স্তনের আকার বড় করা হয়। কেউ কেউ নিতম্বের আকার বাড়াতেও আগ্রহী হচ্ছেন। সেক্ষেত্রে শরীরের কোন স্থানের চর্বি নিয়ে নিতম্বে স্থাপন করে দেয়া হয়।
সার্জন ডা. তাসলিমা সুলতানা জানান, নারীরা যেসব সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে আসছেন, তার মধ্যে রয়েছে স্তন বড় বা ছোট করা অথবা টাইট করা, পেটের চর্বি কমানো, চামড়া ঝুলে গেলে বা মাসল ঝুলে গেলে সার্জারি করে বা মেশিনের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে স্তন বড় করার প্রবণতা বেশি থাকলেও বাংলাদেশে নারীদের ক্ষেত্রে এই চিত্র উল্টো। এখানে অনেক নারী স্তনের আকার কিছুটা ছোট করার জন্য চিকিৎসকদের সহায়তা নেন।
আবার কারও কারও ক্ষেত্রে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মুখের চামড়ায় যেসব পরিবর্তন হয়, চামড়া বেশি ঝুলে যাওয়ার মতো সমস্যার ক্ষেত্রে সার্জারি করে ঠিক করে দেয়া হয়। ডা. তাসলিমা সুলতানা বলছেন, তাদের কাছে যারা চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং খানিকটা উচ্চবিত্ত শ্রেণির।
চিকিৎসা করে বয়সের ছাপ কতটা ঠেকানো যায়?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বা সামাজিক মাধ্যমে সেলিব্রেটিদের সম্পর্কে অনেক সময় লেখা হয় যে, তারা নানা প্রক্রিয়ায় বয়সের ছাপ ঠেকিয়ে রেখেছেন। সাধারণ নারীদের মধ্যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তন দেখা যায়, তাদের চেহারা বা শরীরে সেটা দেখা যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি বা কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে বয়সের ছাপ কমিয়ে আনার কথাও বলা হয়ে থাকে।
ডার্মাটোলজি অ্যান্ড অ্যাসথেটিক প্রাকটিশনার ডা. শারমিন রেজা বুবলি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বয়সের ছাপ পুরোপুরি লুকানো বা ঠেকানো যায় না, কিন্তু কিছু অংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ''আগে থেকে সচেতন হলে, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারলে বয়সের ছাপ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু যারা একটু দেরি করে আসেন, যাদের চেহারায় বা শরীরে অলরেডি বয়সের ছাপ চলে এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে সময় বা ট্রিটমেন্ট একটু বেশি লাগে,'' তিনি বলছেন।
তার কাছে বাংলাদেশের অনেক নারী আসেন ত্বকের চিকিৎসা করাতে। ''বাংলাদেশের মানুষ সবসময়েই সৌন্দর্য-প্রিয় ছিল, এখন সেটা আরও বেড়ে গেছে। আমাদের কাছে সবাই আসে সুন্দর এবং হেলদি স্কিন পেতে। সবার একটি কমন চাহিদা থাকে যে কীভাবে তারা উজ্জ্বল সুন্দর স্কিন পেতে পারে।'' এজন্য তারা নানারকম থেরাপি, লেজার ট্রিটমেন্ট, অ্যান্টিএজিং ট্রিটমেন্ট করে থাকেন।
ডা. শারমিন রেজা বুবলি বলছেন, নায়ক-নায়িকাদের অনেকে খাওয়া দাওয়া, শরীর চর্চা ইত্যাদির পাশাপাশি এসব থেরাপির ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ফলে তাদের শরীরে সহজে বয়সের ছাপ পড়ে না। যে যত মনোযোগের সঙ্গে এটা করেন, তিনি ততো ফিট বা সুন্দর থাকতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়- যখন তারা চিকিৎসকের কাছে আসেন, ততদিনে চেহারায় বা শরীরে একটা ছাপ পড়ে গেছে।
তবে যারা ঠোট, নাক ইত্যাদি ওষুধ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে সুগঠিত করেন, তাদেরকে কিছুদিন পরপর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। কিন্তু কসমেটিক সার্জারি করে যদি ছোট বা নাকের গঠন পরিবর্তন করা হয়, তাহলে পরবর্তীতে তার জীবনযাপনে সেটার আর খুব একটা প্রভাব পড়ে না।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটা আছে?
চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসা শাস্ত্র অনুসরণ করে যেসব থেরাপি বা অস্ত্রোপচার করা হয়, সেখানে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় না। কিন্তু যারা সেটি অনুসরণ করেন না, তাদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ডা. শারমিন রেজা বুবলি বলছেন, "প্রতিটি চিকিৎসা বা ট্রিটমেন্টের ভালো সাইডের পাশাপাশি কিছু ডাউনসাইড থাকে। যেমন যখন আমরা স্কিনে ট্রিটমেন্ট করি, তখন সেখানে ইনজেকশন দিতে হয়, সেখানে লাল হতে পারে, চুলকাতে পারে। সেটা আমরা রোগীকে বলে দেই, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে তাকে পাঁচ সাতদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু খুব দীর্ঘমেয়াদী কোন ক্ষতিকর দিক আমরা দেখতে পাইনি।"
তবে কেউ কেউ ডার্মাটোলজিস্ট বা অ্যাসথেটিক চিকিৎসকদের বাদ দিয়ে পার্লারে গিয়ে ত্বকের নানা থেরাপি বা চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এরপর অনেক রোগী চামড়া বা ত্বকের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে আসেন বলে জানাচ্ছেন ড. শারমিন রেজা। চীনে কসমেটিক এবং প্লাস্টিক সার্জারির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শরীরের যে অংশে সার্জারি করা হয়েছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার আশেপাশের টিস্যু নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে রোগীকে আরও সার্জারি করে সেটা ঠিক করতে হয়েছে। আবার সার্জারি করার পরেও সেই সার্জারির কাঙ্খিত ফলাফল না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
তবে অ্যাসথেটিক প্লাস্টিক সার্জন ডা. তাসলিমা সুলতানা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে তারা যেসব প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অনুসরণ করেন, সেগুলো সবই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও ব্যবহৃত। ফলে এখানে ক্ষতি বা নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি জানান, বর্তমানে অ্যাসথেটিক বিশেষজ্ঞরা যেসব উপকরণ বা চিকিৎসা দিচ্ছেন, তার প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ অনুমোদিত গাইডলাইন মেনে করা হয়।
''এজিং তো আমরা বন্ধ করতে পারবো না, আমরা এটা কমিয়ে আনতে পারবো। কারণ মানুষের তো বয়স বাড়বেই। কিন্তু আমাদের গাইডলাইন অনুযায়ী যদি তিনি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে পারেন, জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘদিন তিনি ধরে নিজেকে রাখতে পারবেন,'' তিনি বলছেন।
তিনি বলছেন, ''একসময় মানুষ সার্জারি করার কথা শুনেই ভয় পেতো, তাও আবার সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য, সেটা তো ইম্পসিবল? কিন্তু এখন ফেনী, চিটাগাং, সিলেট থেকে রোগীরা আসছেন। আর ঢাকার হাইলি এডুকেটেড বা এলিট সোসাইটির লোকজন তো নিয়মিত এই চিকিৎসা নিচ্ছেন।''
তবে নিতম্ব বাড়ানোর সার্জারি নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক নেতিবাচক আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রাজিলিয়ান বাট লিফট বা বিবিএল পদ্ধতিতে নিতম্ব বাড়াতে তুরস্কে যাওয়া দুজন ব্রিটিশ নারীর মৃত্যুর পর। ব্রিটিশ প্লাস্টিক সার্জনদের একটি এসোসিয়েশন বলছে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
ব্রিটিশ প্লাস্টিক সার্জনদের একটি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাইমন হুইদে বলছেন ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সস্তায় কসমেটিক সার্জারির জন্য প্রলুব্ধ হচ্ছেন এবং এর প্রবণতা বাড়ছে। "ফলে বিদেশে এ ধরনের সার্জারি বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ শুধু শারীরিক নয়, মানসিক বিষয়ও এতে জড়িত"।
পুরুষরা এসব চিকিৎসা কতটা নিচ্ছেন?
ঢাকার একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মাথার চুল প্রতিস্থাপন, ছেলের স্তনের আকার ছোট করা (লাইপোসেকশন) বা পেটের ভুঁড়ি কমানোর চিকিৎসা দিয়ে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রতিষ্ঠানের একজন সার্জন বলছিলেন, এখন অনেক ছেলে নিজেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠেছেন।
"অনেকেই বড় স্তন বা ভুঁড়ির চর্বি কমানোর জন্য, টাক মাথায় চুল লাগানোর জন্য আমাদের কাছে আসে। আগে এসব চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হতো। কিন্তু এখন আমরাই করছি। আমি বলবো, ছেলেরাও এখন শারীরিকভাবে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনে সার্জারি করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন," বলেন তিনি। সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন