চরম ও নজিরবিহীন চাপের মুখে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের প্রধানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তবে দলের নতুন নেতা বেছে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। গতকাল বিকেলে ডাউনিং স্ট্রিটের দরজার সামনে সংক্ষিপ্ত ঘোষণায় বরিস জনসন বলেন, ‘নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু হওয়া উচিত। আজ আমি একটি মন্ত্রিসভা নিয়োগ দিয়েছি। একজন নতুন নেতা নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি দায়িত্ব পালন করবো’।
সংবাদ সম্মেলনে বরিস বলেন, সংসদের আইনপ্রণেতাদের দাবি একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী আসুক। নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ের সময়সীমা আগামী সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন, কারণ ব্যক্তিগতভাবে ভোটারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চেয়েছিলেন। বরিস জনসন মনে করেন, এটি তার দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট সম্পন্ন করা, যুক্তরাজ্যকে করোনা মহামারি থেকে সুরক্ষা এবং ইউক্রেনে পুতিনের হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য পশ্চিমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান। সরকার পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন না জানিয়ে সহকর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাতে সফল হননি। তবে প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদপূর্ণ করতে না পারাকে অত্যন্ত ‘বেদনাদায়ক’ বলে মন্তব্য করেন জনসন। বলেন, নিজ দলের সমর্থন ধরে রাখতে না পারায় সফল হননি তিনি। ভাষণে সবশেষে তার স্ত্রী-সন্তান এবং ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী এবং ডাউনিং স্ট্রিটের সব স্টাফদের প্রতি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান বরিস জনসন।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা তাদের খবরে জানায়, আইনপ্রণেতাদের চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন বরিস জনসন। গত তিন দিন ধরে ক্ষমতাসীন কনজানরভেটিভ পার্টির মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা গেছে। মন্ত্রিসভা থেকে একের পর এক সদস্য পদত্যাগ করায় চাপের মুখে পড়েন বরিস জনসন। লকডাউনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মদের পার্টি, বিতর্কিত নিয়োগ আর কেলেঙ্কারিতে জড়ানোয় গত মাসেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বরিস জনসনের নেতৃত্ব। এরপর থেকেই তার পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আসে।
এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের ঘোষণায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন রুশ রাজনীতিকরা। তারা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘বোকা ভাঁড়’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার ফল ভোগ করছেন বলে তারা উল্লেখ করেন।
রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন জানিয়েছে, তারাও জনসনকে পছন্দ করে না। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জনসনের পদত্যাগের ঘোষণার আগে বলেছিলেন, তিনি আমাদের পছন্দ করেন না, আমরাও তাকে পছন্দ করি না। রুশ ধনকুবের ওলেগ ডেরিপাসকা টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘একজন বোকা ভাঁড়ের গৌরবহীন সমাপ্তি’।
রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার ভিয়াচেস্লাভ বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রধান মতাদর্শী ভাঁড় চলে যাচ্ছে। ইউরোপীয় নেতাদের বিবেচনা করা উচিত এমন নীতি কোথায় নিয়ে যাবে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার আগে থেকেই বারবার তার সমালোচনা করে আসছিলেন জনসন। আক্রমণের পর জনসনের নেতৃত্বে ইউক্রেনের বৃহত্তম পশ্চিমা সমর্থক হয়ে ওঠে ব্রিটেন। পাঠানো হয় অস্ত্র এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুরুতর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যুদ্ধের মধ্যেই ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করতে দুইবার কিয়েভ সফর করেছেন জনসন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, জনসনের পতন পশ্চিমাদের ক্ষয়িষ্ণুতার লক্ষণ। এ গল্পের নৈতিকতা হলো: রাশিয়াকে ধ্বংসের চেষ্টা করবেন না। রাশিয়াকে ধ্বংস করা যাবে না। আপনারা নিজের দাঁত ভেঙে তা গিলতে পারেন।
এদিকে গতকাল বরিস জনসনের পদত্যাগ ঘোষণার পর নতুন ব্রিটিশ নেতা খোঁজার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে কীভাবে জনসনের উত্তরসূরী খোঁজা হবে।
দলীয় প্রধান হতে প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন একাধিক নেতা। প্রত্যেক প্রার্থী দু’জন কনজারভেটিভ আইনপ্রণেতা দ্বারা মনোনীত হতে হবে। এরপর কনজারভেটিভ আইনপ্রণেতারা একাধিক পর্বের ভোট আয়োজন করবেন। প্রতিটি পর্বে গোপন ব্যালটে তাদের পছন্দের প্রার্থীর কথা জানতে চাওয়া হবে। সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া প্রার্থী লড়াই থেকে ছিটকে পড়বেন। দুজন প্রার্থী অবশিষ্ট থাকার আগ পর্যন্ত এই ভোট প্রক্রিয়া চলবে।
এরপর চূড়ান্ত দুই প্রার্থীকে নিয়ে পোস্টাল ব্যালট ছাপা হবে দলের সদস্যদের জন্য। এতে জয়ী প্রার্থী হবেন দলের নতুন নেতা। হাউজ অব কমন্সে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই ডি ফ্যাক্টো প্রধানমন্ত্রী। দায়িত্ব চালিয়ে যেতে আগাম নির্বাচন আয়োজনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু চাইলে তিনি তা করতে পারেন।
কনজারভেটিভ দলের নেতা নির্বাচনে সময়ের ব্যাপ্তি ভিন্ন হয়। এটি নির্ভর করে কতজন নেতা প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন। ২০১৬ সালে ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের তিন সপ্তাহেরও কম সময়ে নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন থেরেসা মে। ২০১৯ সালে দলীয় নেতা হতে জনসনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। থেরেসা মে পদত্যাগের দুই মাস পর ক্ষমতায় আসেন জনসন। সূত্র : বিবিসি বাংলা, রয়টার্স ও স্কাই নিউজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন