চেহারা শনাক্ত করতে পারে চীনের তৈরি এমন ক্যামেরা দেশের আরও বিভিন্ন শহরে স্থাপন করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার, এমনটাই জানিয়েছে এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা তিনজন ব্যক্তি।
এই প্রজেক্ট এর সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিগণ জানিয়েছেন, সিকিওরিটি ক্যামেরা এবং ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি সংগ্রহ ও ইনস্টল করতে জান্তা যে দরপত্র আহ্বান করেছে, সেখানে এই পরিকল্পনাগুলোকে নিরাপদ শহর প্রকল্প হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার লক্ষ্য নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং কিছু ক্ষেত্রে নাগরিক শান্তি রক্ষা করা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহর মাওলামাইসহ অন্তত পাঁচটি শহরের জন্য নতুন ক্যামেরা সারভেইলেন্স প্রকল্প শুরু করেছে।
সূত্র অনুসারে নতুন প্রকল্পগুলোয় সেই পাঁচ শহর ক্যামেরা সিস্টেমগুলো স্থাপন করা হবে যেখানে অপরাধ প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসাবে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তি সরকার পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
এদিকে, এই ব্যাপারে মন্তব্য চেয়ে জান্তার একজন মুখপাত্রকে রয়টার্স কল করলে কলের উত্তর দেননি তিনি। সেই সঙ্গে ১০টি মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্টের কেউই, যার সবগুলোই জান্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাদের কল করেও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জান্তা মিয়ানমারের সাতটি রাজ্য এবং সাতটি অঞ্চলের প্রতিটি শহরের জন্য ক্যামেরা সারভেইলেন্স ব্যবস্থার পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছেন একজন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। তবে এই নজরদারি ব্যবস্থা চালু করার জন্য জান্তার প্রচেষ্টার মাত্রা আগেভাগে কেউ জানতো না।
এই ক্যামেরার জন্য আহ্বান করা দরপত্র জিতেছে ফিসকা সিকিউরিটি অ্যান্ড কমিউনিকেশন এবং নাউং ইয়ো টেকনোলজিস কোম্পনি। এই সংস্থাগুলো চীনা নজরদারি জায়ান্ট ডাহুয়া, হুয়াওয়ে এবং হিকভিশন থেকে ক্যামেরা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কিনবে বলে জানা গেছে।
ফিসকা এবং নাউং ইয়ো, উভয়েরই সদর দপ্তরই ইয়াঙ্গুনে অবস্থিত। ক্যামেরার ব্যাপারে তাদের কল করা হলে তারাও রয়টার্সের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। এমনকি হুয়াওয়ে এবং ডাহুয়া মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের অনুরোধের জবাব দেয়নি।
তবে হিকভিশন একটি বিবৃতিতে বলেছে, তারা কখনও মিয়ানমারের সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি বিক্রি করেনি। এটি আরও বলেছে, তারা মিয়ানমারে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি বিক্রি করেনি। তবে তারা ফেসিয়াল রিকগনিশন সফ্টওয়্যার চালানোর জন্য হিকভিশনের হার্ডওয়্যার বিক্রি করা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দেয়নি তারা।
সূত্র বলেছে, মিয়ানমার প্রকিউরমেন্ট ফার্মগুলো, যারা টেন্ডার জিতেছে তারা কখনও কখনও স্থানীয় এবং আঞ্চলিক কোম্পানি দ্বারা তৈরি ফেসিয়াল রিকগনিশন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে কারণ চীনের সফ্টওয়্যার লাইসেন্সগুলো ব্যয়বহুল। যদিও তারা সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর নাম জানায়নি।
এদিকে, মিয়ানমার প্রকল্প এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকা ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, তারা ভয় করছে যে নতুন প্রকল্পগুলো মানবাধিকার কর্মী এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে ব্যবহার করা হতে পারে, যাদেরকে অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জান্তা কর্তৃক সন্ত্রাসী হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন রয়টার্সকে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নজরদারি ক্যামেরাগুলো (মিয়ানমারের) গণতন্ত্র কর্মীদের জন্য একটি গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করবে, কারণ ক্যামেরার মাধ্যমে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ তাদের গতিবিধি ট্র্যাক করতে, কর্মীদের মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করতে, নিরাপদ ঘর এবং অন্যান্য জমায়েতের স্থানগুলি চিহ্নিত করতে এবং অ্যাক্টিভিস্টদের দ্বারা ব্যবহৃত গাড়ি এবং মোটরসাইকেল শনাক্ত করতে এবং আটকাতে পারবে।’
এদিকে, মিয়ানমারের জান্তা ব্যাপক নজরদারিতে নিয়োজিত। এটি টেলিকম এবং ইন্টারনেট প্রদানকারীদের মধ্যে ইন্টারসেপ্ট স্পাইওয়্যার ইনস্টল করেছে যাতে তারা তার নাগরিকদের যোগাযোগের উপর নজর রাখতে পারে এবং অনলাইনে ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর নজরদারি ও আক্রমণ করার জন্য ‘ইনফরমেশন কমব্যাট’ ইউনিট মোতায়েন করেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
সেনাবাহিনীতে নজরদারি ক্যামেরা ফিড বিশ্লেষণ করছেন এমন এক কর্মকর্তা এনই থুটা, যিনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে সামরিক বাহিনী থেকে সরে এসেছিলেন, তিনি রয়টার্সকে জানিয়েছেন, কতজন অফিসারকে এই কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি অবগত নন, তবে রাজধানী নেপিদোতে সৈন্যদের দ্বারা নিযুক্ত সিসিটিভি কন্ট্রোল রুম পরিদর্শন করার বর্ণনা দিয়েছেন। যদিও রয়টার্স স্বাধীনভাবে এটি যাচাই করতে পারেনি এবং জান্তার মুখপাত্রও এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
মাওলামাইন শহরের টেন্ডারটি ফিসকা এবং নাউং ইয়ো যৌথভাবে জিতেছে। দাউই এবং তাউংগির জন্য টেন্ডারগুলো ফিসকায় গিয়েছে। প্রতিটি শহরে এই বছর শত শত ডাহুয়া ক্যামেরা ইনস্টল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
মাওলামাইনে, এখন ২০০টিরও বেশি ডাহুয়া ক্যামেরা রয়েছে এবং আরও অনেকগুলো স্থাপন করা হবে বলে আরেকটি সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে, জাতিগত অস্থিরতার অঞ্চল কাচিনের রাজধানী মিটকিনাতে এই বছর ডাহুয়া ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল, আর এইচপিএ-আন শহরের সরকার একটি ক্যামেরা সিস্টেম সম্পর্কে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছে।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের আগে, সু চির সরকার মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর নেপিদো এবং ইয়াঙ্গুনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছিল, যখন মান্দালে শহরটি হুয়াওয়ের সঙ্গে ক্যামেরা নজরদারি ব্যবস্থার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
একটি সূত্র জানিয়েছে, নেপিদোতে হুয়াওয়ে ক্যামেরার সঙ্গে ফেসিয়াল রিকগনিশন সফ্টওয়্যার যোগ করা হয়েছিল এবং ইয়াঙ্গুনে, নজরদারি ব্যবস্থায় একটি হিকভিশন ট্রাফিক কমান্ড সেন্টার এবং ক্যামেরা ব্র্যান্ডের মিশ্রণ রয়েছে।
অভ্যুত্থানের পর থেকে, জান্তা মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালেকে বলেছে ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়ে আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের আগে কমপক্ষে ৩০০টি হুয়াওয়ে ক্যামেরা ইনস্টল করা হয়েছিল, আরও কয়েক শতাধিক আসতে পারে। বাগান শহর, যা মিয়ানমারের একটি ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র, সেখানে অভ্যুত্থানের আগে ক্যামেরা নজরদারি ব্যবস্থার জন্য টেন্ডারও করেছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রাখাইন রাজ্যে, যেখানে সেনাবাহিনী একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে লড়াই করছে, সেখানে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ২০১৯ সাল থেকে সিটওয়ে শহর এবং কিছু গ্রামে হুয়াওয়ে ক্যামেরাসহ সিসিটিভি সিস্টেম মোতায়েন করেছে বলেও জানতে পেরেছে রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন