শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া কি গতি আছে ইউরোপের

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

রাশিয়া থেকে জার্মানিতে নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনটি পুনরায় চালুর আগেই জ্বালানি সংকটের মুখে পড়েছিল ইউরোপ। যদিও প্রধান পাইপলাইনটি রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ১০ দিন বন্ধ রাখার পর গত বৃহস্পতিবার আবার প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। এবারের শীতে বাড়ি-ঘর উষ্ণ রাখতে এবং গ্যাসনির্ভর শিল্প চালু রাখতে ইউরোপকে সংগ্রাম করতে হবে। কারখানার বিদ্যুৎ সরবরাহ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শীতে বাড়ি-ঘর গরম রাখতে যে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়, রাশিয়া এরই মধ্যে সে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক করে বলেছেন, এগুলো আরও কমতে পারে।

বার্তা সংস্থা এপি বলছে, বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরুর আগে নর্ড স্ট্রিম-১ এর মাধ্যমে ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়। সরকারি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেছিলেন, পাইপলাইনটি আর চালু নাও হতে পারে। পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে জ্বালানি শক্তিকে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ ইউরোপীয় নেতাদের।
আপাতত রাশিয়া সরবরাহ বন্ধ করেনি, তবে অনেক কমিয়েছে। এমনকি, ইউক্রেনে আক্রমণের আগে রাশিয়া স্বল্পমেয়াদী বাজারে গ্যাস বিক্রি করছিল না। ইইউ রাশিয়ার ব্যাংক ও কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো শুরুর পর রাশিয়া ৬ দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ও ৬ দেশে সরবরাহ কমিয়ে দেয়।
নর্ড স্ট্রিম-১-এর মাধ্যমে ইইউয়ের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানিতে দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ কমিয়েছিল। এর জন্য রাশিয়া কারণ হিসেবে জানিয়েছিল, পাইপলাইনের একটি অংশে সমস্যা দেখা দেওয়ায় সরবরাহে সমস্যা হয়। এটি মেরামতের জন্য কানাডায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, নিষেধাজ্ঞার কারণে তা ফেরত পাঠানো হয়নি। ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা একে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি ও জ্বালানির দাম বাড়াতে পুতিনের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অভিহিত করেন।
শীতের আগে গ্যাসের মজুত পূরণ করতে ২৭ সদস্যের ইইউকে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়েছে। শীতে এ অঞ্চলে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। বাড়ি-ঘর উষ্ণ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে গ্যাসের মজুত কমে। ইইউয়ের লক্ষ্য এখন শীতের জন্য মজুত রাখতে কম গ্যাস ব্যবহার করা। বর্তমানে ইউরোপে গ্যাসের পূর্ণ মজুত ৬৫ শতাংশ। ১ নভেম্বরের মধ্যে ৮০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগে রাশিয়া ইউরোপের প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করত। বর্তমানে তা প্রায় ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলো চাপে পড়েছে। এমন কিছু শিল্পে গ্যাস ব্যবহার করা হয় যা বেশিরভাগ মানুষ সামনে থেকে দেখতে পান না। যেমন: গাড়ির জন্য ইস্পাত ও কাঁচের বোতল তৈরি, দুধ ও পনির পাস্তুরিত করা ইত্যাদি
ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানি সতর্ক করে বলেছে, তাপ উৎপাদনে জ্বালানি তেল বা বিদ্যুতের মতো অন্যান্য শক্তিতে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গলিত ধাতু বা কাঁচ ব্যবহার করতে হয়- এমন সরঞ্জাম তাপ বন্ধ হয়ে গেলে নষ্ট হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে জ্বালানির উচ্চ দাম ইউরোপকে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে মন্দার হুমকি দিচ্ছে। খাদ্য, জ্বালানি ও ইউটিলিটি খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। একটি সম্পূর্ণ কাটঅফ ইতোমধ্যে সমস্যায় জর্জরিত অর্থনীতির জন্য আরও বড় আঘাত হতে পারে। তাই, রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন ইউরোপের প্রধান প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন। এটি বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং জার্মানিতে রুশ গ্যাসের প্রধান উৎস। আরো ৩ পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস আসে। তবে পোল্যান্ড ও বেলারুশের মধ্য দিয়ে আসা পাইপলাইনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ সত্ত্বেও এখনো ইউক্রেন ও সেøাভাকিয়ার মাধ্যমে আরেকটি পাইপলাইন দিয়ে কম পরিমাণে গ্যাস আসছে। যেমনটি তুরস্কের মাধ্যমে বুলগেরিয়াতে আছে। এছাড়াও, নরওয়ে, উত্তর আফ্রিকা ও আজারবাইজান থেকেও পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস আসে।
প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) মতে, জ্বালানির দাম বাড়ার মানে হলো পুতিনের আয় বাড়ছে। আইইএ বলছে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে ইউরোপে তেল-গ্যাস রপ্তানি থেকে রাশিয়ার আয় সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় গড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ মাসে রাশিয়ার জ্বালানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সাধারণত পুরো শীতকালে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি আয়ের প্রায় ৩ গুণ।
পুতিনের হাতে নগদ অর্থ আছে। তিনি ভাবতেই পারেন, অতিরিক্ত ইউটিলিটি বিল ও জ্বালানি মন্দা ইউক্রেনের জন্য ইউরোপীয় জনগণের সমর্থন কমাতে পারে এবং তার পক্ষে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।পুতিন গত মঙ্গলবার বলেছেন, মেরামতের জন্য কানাডায় পাঠানো টারবাইনটি যদি জুলাইয়ের শেষের দিকে ফেরত না দেওয়া হয় তাহলে নর্ড স্ট্রিম-১ এর মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ আরো কমবে। তখন অন্য একটি টারবাইন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য কানাডা বলেছে, একটি কমপ্রেশন স্টেশনের সক্ষমতা ফেরাবে এমন অংশটি ফিরিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপ কী করতে পারে : ইইউ আরও ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির দিকে ঝুঁকছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও কাতার থেকে জাহাজে আনতে হয়। জার্মানি উত্তর সাগর উপকূলে এলএনজি আমদানি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ করছে। এটি শেষ হতে কয়েক বছর লাগবে। ৪টি ভাসমান টার্মিনালের প্রথমটি এ বছরের শেষের দিকে চালু হতে পারে। শুধু এলএনজি এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। টেক্সাসের ফ্রিপোর্টের একটি মার্কিন টার্মিনালে বিস্ফোরণ রাতারাতি ইউরোপে সরবরাহের ২ দশমিক ৫ শতাংশ অফলাইনে নিয়ে গেছে। এটি ইউরোপে বেশিরভাগ এলএনজি সরবরাহ করেছিল। এখন ইউরোপের জন্য সংরক্ষণ ও অন্যান্য জ্বালানির উৎস গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ হিসেব বলা যায়, জার্মানি দীর্ঘদিন ধরে কয়লা প্ল্যান্ট চালাচ্ছে। তারা গ্যাস সংরক্ষণ উৎসাহিত করতে গ্যাস নিলাম ব্যবস্থা করছে এবং সরকারি ভবনগুলোয় আবার থার্মোস্ট্যাট বসিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত বুধবার প্রস্তাব করেছে, সদস্য দেশগুলো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বেচ্ছায় তাদের গ্যাস ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাবে। যদি গ্যাসের ঘাটতি আরো বাড়ে বা উচ্চ চাহিদার ঝুঁকি থাকে তবে ইউরোপজুড়ে বাধ্যতামূলক হ্রাস আরোপের ক্ষমতা চাইছে ইইউয়ের নির্বাহী শাখা ইউরোপীয় কমিশন।
আগামী মঙ্গলবার জ্বালানিমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠকে ইইউ সদস্য দেশগুলো এসব উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করবে। দেশগুলো বিকল্প জ্বালানি সরবরাহ সুরক্ষিত করতে চাপ দিচ্ছে এবং ইতালি, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এই সপ্তাহে আলজেরিয়া, আজারবাইজান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাদের সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সূত্র : রয়টার্স ও এপি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন