ভোগান্তি কাটছে জন্মনিবন্ধনের। সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন করা ছিলো বাধ্যতামূলক। থাকছেনা এখন সেই পদ্ধতি। এখন থেকে শিশুর জন্মনিবন্ধনের জন্য সরাসরি আবেদনপত্র অনলাইনে পূরণ করেই পাওয়া যাবে জন্মনিবন্ধন সনদ। এতে কমবে নাগরিকদের দুর্ভোগের মাত্রা। দিনের পর দিন আর ঘুরতে হবেনা জন্মনিবন্ধন করার সংশ্লিষ্ট দফতরে। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে খোয়াতে হবেনা হাজার হাজার টাকা। গত ২৬ জুলাই ‘জন্মনিবন্ধনে ডিজিটাল ভোগান্তি’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে এ সংক্রান্ত প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়াও জন্মনিবন্ধন সনদ করতে গিয়ে সারা দেশের মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এখন থেকে জন্মনিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্মসনদ আর লাগবে না। ২৭ জুলাই থেকে জন্মনিবন্ধনের আবেদন করতে গেলে সফটওয়্যারে মা-বাবার জন্মসনদ চাওয়া হচ্ছে না। এতে বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তান, যাদের মা কিংবা বাবা যেকোনো একজনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই এবং পথশিশুদের জন্মনিবন্ধন করতে যে জটিলতা ছিল, তা কাটবে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।
সাধারণ নাগরিকরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে সন্তানের জন্মনিবন্ধন পাওয়ার জন্য বাবা-মা তাদের যেসব জন্মনিবন্ধন বাধ্য হয়েই করেছেন তাদের এসব জন্মনিবন্ধনে রয়েছে ব্যাপক ভুল। শুধুমাত্র সন্তানের প্রয়োজনের জন্য করা এই সনদ করতে গিয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সাথে নেই মিল। কোথাও নামে কোথায় বয়সে, বানানে ভুল হয়েছে। এখন তাদের দাবি বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধনে এসব ভুলের জন্য সঠিক সংশোধনের ব্যবস্থা যেন থাকে।
জানা যায়, এখন থেকে শিশুর টিকার কার্ড অথবা হাসপাতালের ছাড়পত্র দেখিয়ে শিশুর জন্মনিবন্ধন করা যাবে। এ নিয়ম আগেও কার্যকর ছিল। তবে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নিয়মে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছিল, ২০০১ সালের পর জন্ম নেয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে তার বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন সনদ অবশ্যই প্রয়োজন হবে। বর্তমানে দেশে ১৬টি মৌলিক সেবা পেতে জন্মসনদ প্রয়োজন হয়। এগুলো হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিয়ের নিবন্ধন, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়োগ, ব্যাংক হিসাব খোলা, গ্যাস-পানি-টেলিফোন-বিদ্যুতের সংযোগ, ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিআইএন), ড্রাইভিং লাইসেন্স, যানবাহন নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, আমদানি ও রফতানি লাইসেন্স, ঠিকাদারি লাইসেন্স, জমির ক্রয়-বিক্রয় ও নিবন্ধন এবং বাড়ির নকশা অনুমোদন।
এখন থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি এতিম, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন, পরিচয়হীন, বেদে, ভবঘুরে, পথবাসী বা ঠিকানাহীন বা যৌনকর্মী হলে যেসব তথ্য অসম্পূর্ণ থাকবে, সেসব স্থানে ‘অপ্রাপ্য’ লিখে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতির কারণ দেখিয়ে নিবন্ধক জন্ম বা মৃত্যুনিবন্ধন প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না। বিয়েবিচ্ছেদ হওয়া মা-বাবার সন্তান ও পথশিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবারের শিশুরাও সাধারণভাবে এখন থেকে অনলাইনে আবেদন করতে পারবে। তবে পথশিশুদের ক্ষেত্রে যারা মা-বাবার নাম বলতে পারবে না, তাদের আগের মতোই নিবন্ধন কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করতে হবে।
দেশে জন্মনিবন্ধনের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০১ সালে। কিন্তু ২১ বছর পরও কার্যকর জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সারা দেশে এখন জন্মনিবন্ধনের হিসেবে জনসংখ্যা কত তাও নির্ধারণ করা সম্ভবনা। কারণ একই ব্যক্তির নামে রয়েছে একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ। আগের জন্মনিবন্ধনে যে অনলাইন সফটওয়্যারের কারণেও পুরোনো সনদ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশ সময় সার্ভারে ঢোকা যেত না।
২০১০ থেকে অনলাইনে জন্মসনদ দেয়া শুরু হয়। ২০১৬ সালে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায় শেষ হয়। সরকার ওই বছরের ১ জুলাই থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম রাজস্ব খাতে নিয়ে আসে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জনসচেতনতা বাড়াতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে সরকার ৬ অক্টোবরকে জাতীয় জন্মনিবন্ধন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের পাশাপাশি বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে অনলাইনের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
অনলাইনে আবেদন থেকে শুরু করে সনদ পাওয়া পর্যন্ত নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়তে হতো। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়েই একটি জন্মসনদ পেতে লেগে যাচ্ছে ৩ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। নতুন এ সেক্টরে দালালরা সিন্ডিকেট করেছে। ফলে অতি আবশ্যকীয় ‘জন্মসনদ’ এর জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে মানুষকে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত একই চিত্র। ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ জন্ম সনদের ফি ৫০ টাকা থেকে দেড়শ’ টাকা হলেও একটি সনদ পেতে এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে কিছু কম্পিউটার কম্পোজের দোকানগুলোর লোকজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেন জন্মনিবন্ধন নতুন ও সংশোধন করে দেয়ার কথা বলে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল মির্জা তারিক হিকমত গণমাধ্যমকে বলেছেন, জন্মনিবন্ধন নিয়ে জনভোগান্তির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মা-বাবার জন্মনিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়া হয়েছে। ২৭ জুলাই থেকে অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের আবেদন নেয়ার সফটওয়্যারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন শিশুর জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে মা-বাবার জন্মসনদ চাওয়া হবে না। জন্মনিবন্ধনের আন্তর্জাতিক ব্যবহার সম্পর্কে জানার কারণে ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা-বাবার জন্মসনদ চাওয়া হতো। সিস্টেম থেকে মা-বাবার জন্মসনদের বাধ্যবাধকতা বাদ দেয়া হয়েছে। সেটা আবেদন করতে গেলেই বোঝা যাবে।
ইতোমধ্যে দেশের দুই লাখ পথশিশুকে জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স নামে একটি সংগঠনের পক্ষে ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল এ রিট আবেদন দায়ের করেন। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব, জন্ম নিবন্ধন অধিদফতর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেছেন, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুই লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে। এসব শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকার কারণে পথশিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। একই কারণে শিশুরা অনেক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর ভিকারুনেচ্ছা নূন স্কুল এন্ড কলেজের এক অভিভাবক ইনকিলাবকে বলেন, গত বছর স্কুলে ভর্তির জন্য তার সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ করেছেন। কিন্তু তিনি সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য তার এবং তার স্ত্রীরও জন্মনিবন্ধন সনদ করতে হয়েছে। আর আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় হওয়ায় আমাদের দুজনের জন্মনিবন্ধন সনদ করতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সন্তানের স্কুলে ভর্তির বিষয় থাকার কারণে কষ্ট করে টাকা খরচ করে হলেও এটি করতে হয়েছে। এখন যদি শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন করতে না লাগে তাহলে অনেক সুবিধা হবে। অনেক কষ্ট লাগব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন