ভাঙন এলাকা থেকেই মেশিন দিয়ে বালু তুলে ভর্তি করা হচ্ছে জিওব্যাগ
প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন
- জিওব্যাগে বালুর বাঁধ দিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণে প্রতিবছর দেশি-বিদেশী লাখো পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণ করে থাকেন। ভ্রমণপ্রিয়াসীদের কথা মাথায় রেখেই সৈকত ঘিরে গড়ে উঠেছে ডজন খানেক পাঁচ তারকাসহ চার শতাধিক হোটেল-মোটেল। পর্যটন কেন্দ্রিক এসব হোটেল-মোটেল থেকে প্রতিবছর টার্নওভার হয়ে থাকে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সৈকতের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ এখন আর আগের মতো নেই। প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে গেছে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট। সৈকতের সবচাইতে আকর্ষণীয় লাবনী পয়েন্ট সাগরের করাল গ্রাসে ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ভাঙন এলাকায় দ্রæত উন্নত মানের টেকসই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে সৈকতের সৌন্দর্য না ফেরালে কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে পর্যটক। মুখ থুবড়ে পড়বে পর্যটন জোনে গড়ে ওঠা হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের পর্যটন খাতে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অব্যাহত ভাঙনে একের পর এক বিলীন হয়ে যাচ্ছে সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে হুমকির মুখে পড়েছে সৈকতে সৃজিত ঝাউ বাগানসহ পর্যটন এলাকার সরকারি বেসরকারি অনেক স্থাপনা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ডায়াবেটিস হাসপাতাল, ট্যুরিস্ট পুলিশ ভবন, সাগর পাড়ের আর্মি রেস্টহাউজ, বিজিবি রেস্টহাউজ, হোটেল সীগাল, হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইজ ও হোটেল সায়মান রিসোর্টসহ হোটেল মোটেল জোনের ১৫-২০টি তারকা মানের হোটেল রয়েছে হুমকির মুখে। একইভাবে কলাতলী, হিমছড়ি, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতের মেরিন ড্রাইভে ভাঙন দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভাঙন এলাকা থেকেই একাধিক মেশিন দিয়ে বালু তুলে ভর্তি করা হচ্ছে জিওব্যাগ। ওই জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধের ব্যর্থ চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে বাঁধে লুটপাট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। পাউবো অফিসসহ সরকার দলের চিহ্নিত কিছু লোক এই লোটপাটের সাথে জড়িত।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাধা সৃষ্টি করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ভেঙে বিলীন হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এ বিষয়ে দীর্ঘ সমীক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, হঠাৎ করে কী কারণে সৈকত ভাঙছে তা জানার জন্য একটি টিম কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সৈকত এলাকা পরিদর্শন করেন। এতে দেখা গেছে, যেখানে সাগর লতার বালিয়াড়ি ও কেয়া-নিশিন্দার বন আছে, সেখানে সাগর তীর ভাঙেনি। বরং সাগর লতায় বালি আবর্জনা আটকে বালিয়াড়ি আরো উঁচু হয়েছে। আর যেখানে ঝাউবন ও অন্য কোনো উঁচু বাঁধ আছে সেখানেই ক্ষয়ের শিকার হয়েছে সৈকতের মাটি। এতে প্রমাণিত হয়, প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই ভাঙছে সমুদ্র সৈকত।
পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আনসারুল করিম মনে করেন, কক্সবাজার সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারণেই ভাঙছে সৈকত। সৈকতের যেখানেই জোয়ারের ঢেউকে বাধা দেওয়া হয়, সেখানেই সৈকতের মাটি ক্ষয়ের শিকার হয়।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমদ বলেন, চলতি মৌসুমে ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে এক কোটি টাকা ব্যয়ে জিওব্যাগে বালুর বাঁধ দেয়া হয়েছে। নাজিরার টেক থেকে বেলী হ্যাচারী পর্যন্ত সৈকতের ১২ কি.মি এলাকায় প্রায় সাড়ে তিনহাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তাসহ টেকসই বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি একনেকে পাশ হলেই কাজ শুরু হবে। তবে এই প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সরকার ঘোষিত পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় সকল ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও তিন বছর আগে দেয়া উচ্চ আদালতের রায় এখনো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। প্রভাবশালীরা দেশের আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে সাগর পাড়ে একের পর এক ৮-১০ তলা ভবন তৈরির কারণে সাগর তীর ভাঙছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকীর বলেন, সমুদ্র ও মূল ভূ-খÐের মাঝখানে সমান্তরালভাবে একটি জলাভ‚মি সৈকত থাকে। ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাগরের উপচে পড়া জোয়ার সৈকতের বালিয়াড়িতে আছড়ে পড়ে। এ সময় কিছু পানি বালিয়াড়ি পেরিয়ে জলাভ‚মি অথবা ক্যানেলের মতো ছোট জলধারায় জমা হয়। যে জলধারাটি সৈকতের সাথে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে এক প্রান্তে গিয়ে বড় জলধারার মাধ্যমে সাগরে মিলিত হয়। আর এই ভ‚-তাত্তি¡ক বৈশিষ্ট যতদিন অবশিষ্ট ছিল, প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাও প্রায় অটুট ছিল। এখন তা আর নাই।
তিনি বলেন, সৈকতে দীর্ঘ উচ্চতা সম্পন্ন বৃক্ষের চাল সৃষ্টির কারণে বালিয়াড়িগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং সাগর তীরে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা বাতামগুলো সৈকতে এসে হঠাৎ ঝাউগাছের মতো দীর্ঘ উচ্চতাসম্পন্ন প্রাকৃতিক ঢালে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নীচের দিকে চাপ তৈরি করে এবং এতে বালিয়াড়ির মাটি সরে যায়। ফলে সাগরতীর ভেঙে যায়। তিনি কক্সবাজার সৈকতের টেকসই সংরক্ষণে একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দেন।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ইসি এলাকায় অর্থাৎ পরিবেশ এ প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় নির্মিত ৪১৩টি হোটেল মোটেল ও নানা স্থাপনার কারণ হচ্ছে এই ভাঙন। বেশ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয়েছে। তার পরও থেমে নেই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ। কক্সবাজার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান জানান, সাগরের ঢেউ যেখানে আছড়ে পড়ে সেখান থেকে কমপক্ষে হাফ কি.মি দূরে স্থাপনা করার নিয়ম রয়েছে। এই কারণে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সৈকত এলাকাকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এলাকা বা ইসি এলাকা ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি ওই এলাকায় গড়ে উঠা স্থাপনা ভেঙে ফেলা ও নতুন করে কোন স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু তাতো মানা হচ্ছেনা।
কক্সবাজার জেলা জাতীয় পার্টির সম্পাদক মুফিজুর রহমান মুফিজ বলেন, কলাতলীর সাগরপাড়ে স্থাপিত ২০টির মত হ্যাচারীর পানি সাগরে পড়ায় সেখানে ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছেনা। কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, সৈকতের ইসি এলাকায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নির্দেশ মানা হচ্ছেনা। সরকারের উচ্চ মহলের দোহাই দিয়ে ইনানী সৈকতে হোটেল রয়েল টিউলিপ সোজা সৈকত দ্বিখÐিত করে নির্মাণ করা হয়েছে স্থায়ী বাঁধ। এই অবৈধ বাঁধের কারণেই লাবনীসহ সৈকতজুড়ে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন