বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ বর্তমান পৃথিবীতে আবিস্কার হচ্ছে নতুন নতুন তথ্য এবং এসব তথ্যের বিকাশ ও প্রয়োগ নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। এ সব গবেষণার সূত্র ধরে প্রস্তুত হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের নিত্য ব্যবহার্য্য দ্রব্য, যা আমাদের জীবনধারণের মান ও মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। দেহকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সে সঙ্গে উন্নত মানের জীবন ভোগ করার লক্ষ্যে আমাদের দৃষ্টি এখন আধুনিক দ্রব্যসামগ্রীর উপর নিবন্ধ। তাই যে প্রকৃতি আমাদের জীবনধারণের প্রকৃত ইন্ধন যোগাচ্ছে, মানবদেহের উপর এর প্রভাবকে আমরা নানাভাবে উপেক্ষা করে চলেছি। প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ বৃক্ষ এবং পরিবেশের উপর বৃক্ষের প্রভাব নিয়ে তাইতো চালানো হচ্ছে নানা প্রকার সচেতনতামূলক অভিযান। পরিবেশ বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে স্কুল-কলেজের পাঠ্য তালিকায়। গাছপালার ব্যবহার ও উপকারিতা নিয়ে পরিকল্পিত চিন্তা-চর্চার ফাঁকে যে বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পাচ্ছে তা নিয়ে এ আলোচনাটির অবতারণা।
দেহকে নীরোগ রাখার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৌলতে প্রস্তুত হচ্ছে নানা প্রকারের ঔষধ, যা ব্যবহারে মানুষের গড় আয়ু উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুক্ষ্মভাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অধিকাংশ ঔষধের উপাদানগুলো গাছপালা থেকে আসছে। মানবদেহের উপর গাছের প্রভাব জানার পর রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এ উপাদানগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে ঔষধের দাম এখন এত বেশি যে অতি সাধারণ একটি রোগের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুতরায় কোন রোগ জটিল আকার ধারণ করার আগে আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা কিছু গাছপালাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের গাছপালায় আচ্ছাদিত আমাদের এ দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। তাই দেহকে নীরোগ রাখার জন্য এ সম্পদ ব্যবহারের লক্ষ্যে উপযুক্ত অভিযান চালানো প্রয়োজন। কিভাবে এ প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত কারা যায় তা বর্ণনা করার পূর্বে কিছু গাছপালা এবং এর উপকারিতা সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক।
* থানকুনি ঃ সাধারণত আদ্রজমিতে বা পুকুরের কিনারায় এ গাছ জন্মায়। এ গাছ বলবৃদ্ধিকারক এবং চর্মরোগ, কুষ্ঠ, ধাতু রোগ ও রক্তদৃষ্টিতে উপকারী। এ পাতা স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং উম্মাদ রোগে এর ব্যবহার রয়েছে।
* হেলেঞ্চা ঃ জলাভূমির কিনারায় বা কাদাটে জমিতে এ গাছ দেখা যায়। কোন কোন সময় পুকুরে এ গাছ পাওয়া যায়। এটি পিত্তধিক্যরাধক এবং চর্মরোগ, যকৃত ও স্নায়ুরোগে উপকারী। এ গাছের রস অনিদ্রা দূর করে।
* আমরুল ঃ পতিত জমি ও বাড়ির আশপাশে এ গাছ দেখা যায়। এটি ক্ষুধাবর্ধক, পেটের পীড়া, আমাশয় ও চর্মরোগে উপকারী। গাছটি স্কার্ভি রোগ নিরাময়ের জন্য প্রসিদ্ধ। অজীর্ণতা রোগে টাটকা পাতার ঝোল ক্ষুধা বাড়ায় ও হজমে সাহায্য করে।
* স্বর্ণলতা ঃ যে কোন বড় গাছের ডালে পরগাছা হিসাবে এ গাছ জন্মায়। এ গাছের বীজ ক্রিমিনাশক, হজমকারক এবং পেটের বায়ুনাশক। চুলকানিতে এর বাহ্যিক প্রয়োগ উপকারী। গাছের নির্যাস ক্ষত ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
* গাঁদা ঃ সর্বত্র এ গাছ ফুলের জন্য চাষ করা হয়। এ ফুল চোখের রোগে উপকারী। এর পাতা শরীরের ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। ফোঁড়া ও কার্বাঙ্কলে এ পাতা উপকারী। ফুলের রস অর্শের রক্তস্রাব নিবারণ করে।
* বনপালং ঃ জঙ্গলের মধ্যে এ গাছটি পাওয়া যায়। এ গাছ স্নিগ্ধতাকারক, প্রস্রাবকারক, প্রতিষেধক, প্রচুর ঘর্মকারক, শ্লেষ্মা নিবারক এবং হাঁপানিত উপকারী।
* গাজর ঃ গ্রামাঞ্চলে সবজি হিসাবে গাজরের চাষ হয়। এ গাছ মূত্রাশয়ের রোগ ও উদরীতে উপকারী। পাতা ও বীজের ক্কাথ সেবনে গর্ভবেদনা বাড়ে এবং তাড়াতাড়ি প্রসব হয়।
* জোয়ান বা জৈন ঃ এ গাছ মসলার জন্য চাষ করা হয়। এটি অগ্নিবর্ধক, হজমকারক, উত্তেজক, উদরাময়ে উপকারী এবং স্থায়ী অগ্নিমান্দ্যে বিশেষ উপকারী। টনসিলাইটিস, দস্তরোগ ও অর্শে এর ব্যবহার রয়েছে।
* ধনে বা ধনিয়া ঃ সাধারণত মসলার জন্য এর চাষ হয়ে থাকে। এ ফল হজমকারক, মূত্রবর্ধক এবং অগ্নিবর্ধক। ধনে চিবোলে মুখের দুর্গন্ধ নাশ হয়। * হাতি গুড়া ঃ পতিত জমি, ড্রেনের ধার, রাস্তার কিনারা এবং খারিফ ফসলে এ গাছ দেখা যায়। এ গাছের পাতা ফোঁড়া, ঘা এবং যে কোন কীট দংশনে উপকারী। স্থানীয়ভাবে ক্ষত ও দাঁতের ফোঁড়া নিরাময়ে এর ব্যবহার হয় । চোখ উঠায় এ গাছের পাতা প্রলেপ উপকারী।
এভাবে নিম, তুলসি, আমলকি, ফণিমনসা, চন্দ্রমূলী, আদা, ঘৃতকুমারী শতমূলী, কুমারিকা, ঈষলাঙ্গুলা, রক্তদ্রোণ, গোখরা, কেশরাজ, ভীমরাজ, বন ওকড়া প্রভৃতি অনেক প্রকার ঔষধী গাছের নাম উল্লেখ করা যায় আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। অথচ এগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহারে আমাদের উৎসাহ নেই। তাই পরিকল্পিতভাবে যদি আমরা এসব গাছপালার গুণাগুণ সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে পারি তবে অতি সামান্য ব্যয়ে প্রাথমিক স্তরের যে কোন রোগ স্থায়ীভাবে নির্মূল করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে বিলুপ্ত প্রায় কিছু গাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। এর জন্য সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত নবজাগরণ দরকার। এ অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য কিছু পদক্ষেপ প্রস্তাব করা যেতে পারে।
ক) এ বিষয়টির উপর জ্ঞান থাকা ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে তা নানাভাবে প্রচার করা।
খ) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তত্ত্বাবধানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয় ছড়িয়ে দিতে হবে।
গ) বেসরকারী সংস্থার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রকার ঔষধী বৃক্ষ সংগ্রহ করে তা প্রদর্শনীয় ব্যবস্থা করা।
ঘ) বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর উদ্যোগে এ বিষয়টির উপর আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
ঙ) এ বিষয়টিকে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া ইত্যাদি।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন