মিয়ানমারজুড়ে সাধারণ জনগণ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে বলে বিশ্বসম্প্রদায়কে সতর্ক করেছেন মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ। গত বৃহস্পতিবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে তিনি মিয়ানমার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। আবেগঘন বত্তৃদ্ধতায় টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, ‘এখানে আমাদের সবার দায়িত্ব আছে। আর মিয়ানমারের জনগণকে রক্ষায় আমরা সবাই ব্যর্থ হচ্ছি। ইউক্রেন আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ সদস্যদের কয়েক দিন লেগেছিল। মিয়ানমারের জনগণ তাদের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা দেখতে পাচ্ছে। তারা আশ্চর্য হচ্ছে, তাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্বিচার আক্রমণের পরও কেন বিশ্বের আচরণ ভিন্ন?’ টম অ্যান্ড্রুজ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এখনই মিয়ানমারের জনগণকে রক্ষায় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এখনই উদ্যোগ নিন, নয়তো ছয় মাস পর এর চেয়ে অনেক খারাপ খবর আপনাদের জানাতে বাধ্য হব। ’ টম অ্যান্ড্রুজ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমার সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, পরিস্থিতি ‘খারাপ’ থেকে ‘আরো খারাপ’ হচ্ছে। গত তিনি মিয়ানমার পরিস্থিতিকে ‘ভয়ংকর’ বলে অভিহিত করেছেন। টম অ্যান্ড্রুজ মিয়ানমারের আশপাশের দেশগুলোকে আরো শরণার্থীর চাপ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেন, এই মুহূর্তে মিয়ানমারে কাউকে ফেরত পাঠানো আর কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া একই কথা। তিনি ‘তৃতীয় দেশে শরণার্থী স্থানান্তরের’ উদ্যোগ নিতেও বিশ্বসম্প্রদায়কে আহ্বান জানান। মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত মানবাধিকার পরিষদকে জানান, মিয়ানমারজুড়ে সংঘাত বিস্তৃত হচ্ছে। জান্তার বিরুদ্ধে বেসামরিক জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। সশস্ত্র নৃগোষ্ঠীগুলো জান্তার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ জোরদার করছে। টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, জান্তার বাহিনী ও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র হচ্ছে। নবগঠিত ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ (জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী) দেশজুড়ে সামরিক বাহিনীকে আক্রমণ করছে। মিয়ানমারের প্রতিটি প্রান্তে জান্তা খুবই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রপন্থী বাহিনীগুলোর সমর্থক—এমন ভাবনা থেকে তাদের জন্য ত্রাণসামগ্রীও আটকে দিচ্ছে সামরিক জান্তা। এর ফলে অগণিত নিরপরাধ ব্যক্তি খাদ্য, ওষুধ, এমনকি বেঁচে থাকার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। টম অ্যান্ড্রুজের বক্তব্যের পর জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) প্রতিনিধিরা বলেন, পাঁচ বছর ধরে মিয়ানমারে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ২০২১ সালে অবৈধ সামরিক অভ্যুত্থানের পর জান্তা মিয়ানমারে পুরো জনগোষ্ঠীকেই জিম্মিতে পরিণত করেছে। পুরো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই এখন গণনৃশংসতা চলছে। আলোচনায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ণ, নিরাপদ ও অবাধ মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের সুযোগ থাকা অপরিহার্য ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসইভাবে ফেরার জন্য পরিবেশ ও মানবিক সহায়তাকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। এই সংঘাত বাংলাদেশ, ভারতসহ এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলছে। মানবাধিকার পরিষদে গতকালের অধিবেশনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল-নাশিফ বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটিতে নগর, শহর ও গ্রামগুলোতে বল প্রয়োগ করছে। তাদের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে মিয়ানমারের জনগণ। আলোচনায় অংশ নিয়ে চীনের প্রতিনিধি মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে সম্মান জানানোর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি মিয়ানমারের জনগণের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। মিয়ানমারের প্রতিনিধি মানবাধিকার পরিষদে আলোচনায় অংশ না নেওয়ায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। মিয়ানমারকে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন না করার আহ্বান বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতায় বাংলাদেশ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তিনি মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘিত হয়, এমন যেকোনো কাজ থেকেও তিনি মিয়ানমারকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন