শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

যে কারণে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০২২, ২:০৮ পিএম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস তৈরি হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সেটি বিশ্বকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার কারণেই জাতিসঙ্ঘের মতো সংস্থার ভিত্তি রচিত হয়। এ সংক্রান্ত বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

তবে যুদ্ধ থেকে বিশ্বকে রক্ষা আর সার্বভৌম দেশগুলোর মধ্যে সমতামূলক নিরাপত্তার আদর্শিক ভাবনা থকে জাতিসঙ্ঘের জন্ম হলেও সংস্থাটির জন্মের পরেও অনেকগুলো যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, যুদ্ধের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংস্থাটি যুদ্ধ ঠেকাতে পারেনি এটি ঠিক। কিন্তু বৈশ্বিক মানবাধিকার ও মানবিক কার্যক্রমে বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে।

তবে বিশ্লেষকরা যাই বলুক, বাস্তবতা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বড় কোনো সঙ্কট যেমন সিরিয়া, ইরাক কিংবা রোহিঙ্গা- যাই হোক না কেন প্রভাবশালী দেশগুলোর বাইরে গিয়ে এসব বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেয়া আর কিছু প্রস্তাব পাস করা ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা জাতিসঙ্ঘ দেখাতে পারেনি।

আবার অনেক ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ যেসব সিদ্ধান্ত পাস করেছে তাকে গুরুত্বই দেয়নি প্রভাবশালী দেশগুলো। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক কিংবা সোমালিয়া- জাতিসঙ্ঘকে কেবল ব্যবহার করেছে কিংবা উপেক্ষা করেছে বিশ্বশক্তিগুলো।

এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে জাতিসঙ্ঘ অনেক তৎপরতা দেখালেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতিই হয়নি কার্যত কিছু প্রভাবশালী দেশের কারণেই।

কিভাবে তৈরি হয়েছিল জাতিসঙ্ঘ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসঙ্ঘের জন্ম হলেও এটির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত লিগ অব নেশনসের ব্যর্থতার কারণেই। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বনেতাদের একাধিক বৈঠক ও সম্মেলনে তাই নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

জাতিসঙ্ঘের ওয়েবসাইটে অবশ্য বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের ইতিহাস এখনো লেখা হচ্ছে, যার যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৫ সালে। মূলত-এর সনদ চীন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এবং সিগনেটরি দেশগুলোর বেশিরভাগ অনুমোদনের পর যাত্রা শুরু হয়।

তবে সব মিলিয়ে মূল সনদে ৫১টি দেশ স্বাক্ষর করলেও এখন এর সদস্য সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিস অফ দ্যা হিস্টোরিয়ান জাতিসঙ্ঘ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে লিখেছে যে, ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি জার্মানি-ইতালি জোটের সাথে যুদ্ধরত ২৬টি জাতির প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটনের সমবেত হন জাতিসঙ্ঘের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরের জন্য এবং এর মাধ্যমে তারা আটলান্টিক চার্টার অনুমোদন করেন।

আটলান্টিক চার্টার হলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একটি যৌথ ঘোষণাপত্র। ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের বৈঠকের পর এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়।

তারা মূলত বৈঠকে বসেন বিশ্বযুদ্ধের পরের একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যে। এই চার্টারে আটটি নীতি সন্নিবেশ করা হয় দেশ দু’টির অঙ্গীকারের ভিত্তিতে।

যুদ্ধের সময় যেসব দেশকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয় তাদের নিজস্ব সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি সব মানুষকে নিজের সরকার পদ্ধতি নিজেকে ঠিক করার বিষয়ে সমর্থন যোগাতে দেশ দু’টি একমত হয় এই সনদে।

এরপর ১৯৪৩ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি ঘোষণাপত্রের খসড়ার বিষয়ে একমত হন যাতে সব সার্বভৌম দেশের সমতার ওপর ভিত্তি করে একটি সাধারণ আন্তর্জাতিক সংস্থার আহ্বান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ওই বছরের অক্টোবরে মস্কোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে একটি ঘোষণাপত্র ইস্যু করা হয় এবং নভেম্বরে তেহরানে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের সাথে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রস্তাব দেন।

সেখানে সব সদস্য রাষ্ট্রের একটি সাধারণ পরিষদ আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের জন্য ১০ সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটির প্রস্তাব করা হয়। আর যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন শান্তি রক্ষায় কাজ করবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়।

এরপর কয়েকটি ইস্যুভিত্তিক সংগঠন তৈরি করা হয়। যেমন খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (মে ১৯৪৩), জাতিসঙ্ঘ ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রশাসন (নভেম্বর ১৯৪৩), জাতিসঙ্ঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন (এপ্রিল ১৯৪৪), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্ব ব্যাংক (জুলাই ১৯৪৪) এবং আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (নভেম্বর ১৯৪৪)।

১৯৪৪ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের প্রতিনিধিরা, যার উদ্দেশ্য ছিলো যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সংস্থার সনদের খসড়া তৈরি করা।

তারা সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য সাধারণ পরিষদ ও বড় চার রাষ্ট্রের সমন্বয়ে নিরাপত্তা পরিষদ, যাতে আরো ছয় সদস্য থাকবেন সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মনোনীত এমন সুপারিশ করেন।

তবে ভোটিং প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা চূড়ান্ত হয় রাশিয়ার ক্রাইমিয়াতে ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে রুজভেল্ট ও স্তালিন একমত হন যে ভেটো নিরাপত্তা পরিষদের কোনো আলোচনাকে ঠেকাতে ব্যবহার করা হবে না।

এরপর ১৯৪৫ সালের এপ্রিল-জুন সময়ের মধ্যে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসঙ্ঘ সনদ চূড়ান্ত করতে সান ফ্রান্সিসকোতে বৈঠকে বসেন।

শেষ পর্যন্ত একটি সাধারণ পরিষদ, পাঁচ স্থায়ী সদস্যসহ ১১ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ, ১৮ সদস্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, একটি আন্তর্জাতিক আদালত, কিছু ঔপনিবেশিক ভূখণ্ডের জন্য ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং একজন সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বে একটি সচিবালয়ের কথা বলা হয় ওই সনদে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে জাতিসঙ্ঘ সনদ অনুমোদন পায় ১৯৪৫ সালের ২৮ জুলাই যার পক্ষে ৮৯ ও বিপক্ষে মাত্র দু’টি ভোট পড়ে।

শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসঙ্ঘ কার্যকর হলো এবং এর সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টারের সেন্ট্রাল হলে ১৯৪৬ সালের ১০ জানুয়ারি।

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বড় যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের পর ইউরোপে এমন উদ্যোগ আগেও ছিল। আবার যুদ্ধের পর অনেক শান্তি চুক্তি হয়। জাতিসঙ্ঘের উৎপত্তিও এ ধরণের একটি পুনরাবৃত্তি। তবে এটি তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পনা করেই। এতে ছিল যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয়। মূলত জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে।

জাতিসঙ্ঘ কি অকার্যকর?

সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতা ও আচরণে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। কারণ দেশটির সাধারণ মানুষ মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য সংস্থাটি কোনো ভূমিকা কার্যত রাখতে পারেনি।

লিবিয়া ও ইরাকে জাতিসঙ্ঘ আসলে গুরুত্বই পায়নি। যদিও যুদ্ধ থেকে মানুষকে রক্ষার অঙ্গীকারই ছিল জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি।

এখনো ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে এবং এর প্রভাবে টালমাটাল হয়ে উঠেছে বিশ্ব। কিন্তু জাতিসঙ্ঘকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, যেকোনো আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সংগঠনই আংশিকভাবে অকার্যকর থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই দেখুন। জাতিসঙ্ঘও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ এটি সত্যি। কিন্তু বিকল্প আর কোনো বৈশ্বিক সংস্থা নেই। বরং আগের যেকোনো সংস্থার চেয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এটি ভালো করেছে।

যদিও জাতিসঙ্ঘকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে ও প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে ভেটো দিয়ে সংস্থাটিকে অকার্যকর করা হয়েছে বিভিন্ন ঘটনায় তারপরেও মানবাধিকার ও মানবিক নানা ইস্যুতে সংস্থাটি বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে।

দেলোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘কিছু সদস্য রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের সাথে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা একাকার হয়ে যাওয়াটাই-এর বড় ব্যর্থতা। আর-এর ভেতরেও কিছুটা অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যদিও সংস্কারের মাধ্যমে এটিকে আরো কার্যকর করার সুযোগ আছে।’ সূত্র : বিবিসি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন