রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নেতাদের রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসার জন্য উন্মুক্ত হতে আহ্বান করেছে এবং শান্তি আলোচনায় জড়িত হতে ইউক্রেনের প্রকাশ্য অস্বীকৃতিকে ত্যাগ করার জন্য উৎসাহিত করছে।
শুক্রবার কিয়েভ সফরে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য একটি ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি সমর্থন করেছে এবং বলেছেন যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নির্বিশেষে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এই আলোচনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মতে, বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনুরোধের উদ্দেশ্য ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে ঠেলে দেয়া নয়, বরং, আগামী বহু বছর ধরে চলার সম্ভবনাযুক্ত যুদ্ধটির ইন্ধনের অভিযোগের ব্যাপারে কিয়েভের সরকারের প্রতি শঙ্কিত দেশগুলির সমর্থন বজায় রাখা। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপটি ব্যাখ্যা করে যে, ইউক্রেনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের অবস্থান কতটা জটিল হয়ে উঠেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কিয়েভকে ‘যতদিন সময় লাগে’ বিপুল পরিমাণ সহায়তা দিয়ে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং গত আট মাস ধরে সঙ্ঘাতের সমাধানের প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু এই যুদ্ধ সমাপ্তির দিকে না যেয়ে বরং বিশ্ব অর্থনীতিকে একটি চরম মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। এবং মার্কিন কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অস্বীকৃতি ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কিছু অংশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, যেখানে খাদ্য এবং জ্বালানীর প্রাপ্যতা এবং ব্যয়ের উপর যুদ্ধের বিঘ্নিত প্রভাবগুলি সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।
তবে, রাশিয়া বরাবরই বলে আসছে যে তারা এখনও ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। এর আগে, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছিলেন যে, রাশিয়া তার পশ্চিমা সহকর্মীদের কথা শুনতে প্রস্তুত যদি তারা মস্কোর স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে উত্তেজনা হ্রাসের বিষয়ে একটি আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভও বলেছিলেন যে, ইউক্রেনের বিষয়ে আলোচনা প্রাথমিকভাবে ওয়াশিংটনের সাথে হওয়া উচিত, কারণ কিয়েভ ‘বহিরাগত আদেশের অধীনে’ কাজ করছে। আলোচনায় বসা নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহ, ইউক্রেনের সরাসরি অস্বীকৃতি এবং প্রলম্বিত যুদ্ধের ভয়াবহতা ক্রমেই ইউক্রেনের প্রতি বৈশি^ক সমর্থন কমিয়ে দিচ্ছে। ওয়াশিংটন এবং কিয়েভের মধ্যে সংবেদনশীল কথোপকথন নিয়ে আলোচনা করার জন্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ইউক্রেনের অনীহা আমাদের কিছু অংশীদারদের জন্য একটি বাস্তব বিষয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের জরিপগুলি বলছে যে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে অর্থায়ন অব্যাহত রাখার জন্য রিপাবলিকানদের সমর্থন দিনকে দিন কমছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দ্বারা ৩ নভেম্বর প্রকাশিত একটি জরিপ অনুসারে, মার্চ মাসের ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে সম্প্রতি ৪৮ শতাংশ রিপাবলিকান বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ‘অত্যধিক’ করছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরেও প্রগতিশীলরা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এড়াতে কূটনীতির আহ্বান জানাচ্ছেন, লিখিত মন্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু পরে দলের একাত্মতার স্বার্থে বাইডেনকে লড়াই থামানোর জন্য ‘একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা’ খোঁজার প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি প্রত্যাহার করছেন।
যুদ্ধের সাথে আংশিকভাবে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ৮ নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে বাইডেন এবং তার দলের জন্য পথের কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। এবং মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তার ভবিষ্যত সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, যার মাধ্যমে যুদ্ধের পর থেকে ইউক্রেনকে এপর্যন্ত ১ হাজার ৮ শ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মঙ্গলবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর ইউক্রেন সংক্রান্ত অবারিত ব্যয় বিলটি হোয়াইট হাউসে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রবীণ কূটনীতিক আলেকজান্ডার ভার্শবো, যিনি রাশিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ন্যাটোর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, বলেছেন যে, ইউরোপীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মার্কিন আগ্রহের প্রেক্ষিতে কীভাবে এবং কখন যুদ্ধ শেষ হবে, সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ উদাসীন হতে পারে না।
মস্কোর সাথে সম্পর্কের কারণে বা ওয়াশিংটনের অবহেলার লাইনে পড়তে অনিচ্ছার কারণে ইউক্রেনের সমর্থনে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন জোটের পিছনে দাড়াতে ইতস্ততকারী দেশগুলির মধ্যে একটি দীর্ঘ সঙ্ঘাতের উদ্বেগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ আফ্রিকা সাম্প্রতিক রাশিয়ার সংযুক্তিকরণের আদেশের নিন্দা প্রস্তাবে জাতিসংঘের ভোট থেকে বিরত থেকেছে এবং বলেছে যে, বিশ্বকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিক সমাধানের সুবিধার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন, জেলেনস্কি যুদ্ধের জন্য পুতিনের মতোই সমান দায়ী। এছাড়া, বিশে^র শীর্ষ ধনকুবের এলন মাস্ক, যিনি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ডিভাইস সরবরাহ করতে সহায়তা করেছেন, টুইটারে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন রাশিয়াকে গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের কিছু অংশ অধিগ্রহন করতে এবং ক্রেমলিন দাবিকৃত ক্রিমিয়াকে ফেরত দিয়ে যুদ্ধের ইতি টানতে।
ইতিমধ্যেই এই যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও গভীর করেছে, যা ইউরোপীয় ভোক্তাদের জন্য জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং পণ্যের দামে বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এবং সোমালিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানের মতো দরিদ্র দেশগুলির খাদ্য সঙ্কটকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এপ্রেক্ষিতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি মস্কো এবং কিয়েভের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন, গত মাসে জেলেনস্কিকে শান্তি আলোচনায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন। ইউক্রেনের নেতা তাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে, ইউক্রেন পুতিনের সাথে কোনও আলোচনা পরিচালনা করবে না। ইউক্রেনীয় নেতারা পুতিনের সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানালেও এবং সমস্ত ইউক্রেন পুনরুদ্ধার করার লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, তারা বিশ্বাস করেন, জেলেনস্কি আলোচনাকে সমর্থন করবেন এবং শেষ পর্যন্ত শর্তগুলি গ্রহণ করবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন