শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

গণতন্ত্র নয়, ভারতে পশ্চিমাদের স্বার্থ চীনের বিরুদ্ধে লড়াই

বিদেশী গণমাধ্যমগুলির ওপর নরেন্দ্র মোদির স্বৈরাচার

দ্য ইকোনোমিস্ট | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:১৩ এএম

গত মাসে বিবিসির (শুধুমাত্র ভারতের বাইরে) একটি দুই পর্বের তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’-এর সম্প্রচারের পর বিবিসি ভারতের কার্যালয়গুলিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের সাম্প্রতিক হেনস্থা অভিযান গণতন্ত্রের মাতা ভারতের কদর্য অবস্থাটি উন্মোচিত করেছে। বিবিসি অপরাধ যে, এটি ভারতের সাধুবাবা মোদির ২ কোটি মুসলমানকে দানবরূপে চিহ্নিত করার আজীবনের রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে তুলে ধরেছে। এটি গুজরাটে মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ২০০২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নিয়ে তার সমস্ত ভূমিকা ফাঁস করে দিয়েছে, যেখানে ১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল এবং যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম। তখন কয়েক ডজন মুসলিম নারী ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং সুসংগঠিত হিন্দু জনতা তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে দিয়েছিল। তথ্যচিত্রটি দীর্ঘকাল ধরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের সহিংসতার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের একটি অপ্রকাশিত প্রতিবেদনের উল্লেখ করেছে। প্রতিবেদনটি ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ‘জাতিগত-শুদ্ধি’র একটি সংগঠিত প্রচারণার তথ্য দিয়েছে, যা সহিংসতাকে সক্ষম করে, এমন একটি ‹দায়মুক্তির পরিবেশ› সৃষ্টির জন্য মোদিকে ‹সরাসরি দায়ী› বলেছে।
ভারতে তথ্যচিত্রটি নিষিদ্ধ করার জন্য গণমাধ্যমগুসহ অন্যান্য প্লাটফর্মে স্বৈরাচার মোদি সরকার জরুরি ক্ষমতা আইন ব্যবহার করেছে। যখন ছাত্ররা দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি প্রদর্শনের করার চেষ্টা করেছিল, কর্তৃপক্ষ সেখানকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মোদির ক্ষমতাসীন দল বিজোপির মুখপাত্র ব্রিটিশ সম্প্রচারক বিবিসিকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যারা ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ইন্ধনমূলক কাজে নিয়োজিত। অবশ্য বিবিসিকে হেনস্থা করাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতা ব্যবহার করে আইনী মারপ্যাঁচে ফেলে সমালোচকদের শাস্তি দেয়া মোদি প্রশাসনের একটি প্রিয় কৌশল, যখন তারা তাকে ভয় দেখাতে চায় বা যারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা তার দলের দোষ খুঁজে বের করার দু:সাহস করে। ২০২০ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হিমায়িত করার পর ভারতে এর কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। গত বছর অক্সফাম ইন্ডিয়া এবং দিল্লির গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’ আয়কর কমকর্তাতের হয়রানির শিকার হয়েছিল। ভারতীয় গণমাধ্যম, সংগঠন, সাংবাদিক এবং কর্মীরা যারা মোদিকে নারাজ করেছেন, তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
প্রতিশোধ, নরেন্দ্র মোদির সরকার, বা তার অন্ধ অনুসারী, যাদের দ্বারাই তা সম্পাদিত হোক না কেন, সেগুলির মধ্যে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া, বিনা বিচারে আটক এবং নৈরাজ্যবাদী হিন্দুত্ব মতাদর্শের সমালোচক গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিক হত্যাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের একটি অংশ তো এই ধরনের প্রতিশোধগুলি গণমাধ্যমে ঘটা করে কোরিব্যান্টিক উদযাপন করে। ভারতে হিন্দু জাতির জন্য এগুলি একটি করে বিজয় হিসাবে প্রদর্শিত হয়, যে দেশটিকে তারা ভুল করে আশ্চর্য বৈচিত্র্যেময় দেশ হয়ে উঠবে বলে মনে করে। সংবাদ সংস্থা ‘দ্য ওয়্যার’-এর কলামিস্ট অপূর্বানন্দ উল্লেখ করেছেন যে, নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বিক্রেতা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চও ভারতে কাজ করলে মোদির প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু হবে। হিন্ডেনবার্গ ভারতের অন্যতম বৃহত্তম সংস্থা আদানি গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিস্ফোরিত বিশ্লেষণ সামনে নিয়ে আসায় এটি ১৩শ’ কোটি ডলার হারিয়েছে। এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান অংশীদার গৌতম আদানি মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মিত্র। তাই বিবিসি, অ্যামনেস্টি, লঙ্কেশ এবং বাকিদের মতো হিন্ডেনবার্গকেও ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের একই ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্রের দায় নিতে হবে।
কেউ কেউ ভাবছেন যে, মোদি বিবিসির ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করেছেন কিনা, বিশেষ করে এমন একটি বছরে যখন ভারত জি২০ এর আয়োজক হিসাবে বিশে^র মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। কিন্তু গত মাসে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক পরিস্কার বলে দিয়েছেন যে, মোদির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের অপ্রকাশিত প্রতিবেদনটির সাথে তিনি মোটেও একমত নন। মোদির পশ্চিমা মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং বাকিরা ভারতে সংখ্যালঘু অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে মাঝে মাঝে সামান্য উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। তাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল ভারতীয় বাজারের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং চীনের সাথে পশ্চিমের আধিপত্যের লড়াইয়ে ভারতকে বাঁধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য তাদের আকাক্সক্ষা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন