সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে বিনোদনের শিষ্টাচার

| প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

\ আট \
মানুষ আনন্দের সময় হাসে। হাসিহচ্ছে এক প্রকার মুখমন্ডলীয় বহিঃপ্রকাশ, যা সচরাচরভাবে মুখের নমনীয় পেশীকে দু পাশে প্রসারিত করার মাধ্যমে অর্জিত হয়। মুখমন্ডল ছাড়াও চোখের মধ্যে হাসির বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠতে পারে। হাসি আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের প্রতি এক বড় নিয়ামত। হাস্যোজ্জল চেহারায় মানুষের সাথে কথা বলা রাসূল স. এর আদর্শ। মানুষের হাস্যোজ্জ্বল কথা বলে সময় কাটানোর তার স্বাস্থ্য রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, হাসি শুধুমাত্র চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম নয়; বরং হাসিমুখে কথা বলা আমাদের প্রিয় নবী স. এর সুন্নাতও। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। হাদীসে একে অপরের প্রতি মুচকি হাসাকে সাদাকাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ স. বলেন, তোমার ভাইয়ের প্রতি মুচকি হেসে কথা বলাটা সাদাকাহর সমতুল্য। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলাম সীমালংঘন করে না। তাই মাত্রাতিরিক্ত হাসাহাসি কিংবা হাসানোকে ইসলাম বরাবরই নিরুৎসাহিত করেছে। রাসূলুল্লাহ স. বলেন, অধিক হাসি অন্তরকে মেরে ফেলে
কৌতুক বা রসাত্মক কথা ঃ কৌতুক করা মানে আমোদ ও মজা করা, আনন্দ উপভোগ করা। শারীআতের সীমারেখা অনুসরণ করে কৌতুক করা এবং রসাত্মক কথা বলে মজা করা ইসলামে দূষণীয় নয়। এ ক্ষেত্রে শারীআতের নির্দেশনা হলো- কৌতুক সত্য নির্ভর হবে এবং এর মাধ্যমে কারো মান সম্মান হরণ হবে না কিংবা কারো প্রতি বিদ্রæপ প্রকাশ পাবে না। কাজেই বিনোদনের নামে এমন কোন কৌতুকের আশ্রয় নেয়া যাবে না, যাতে মিথ্যার সংমিশ্রণ রয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরাইরা রা. বলেন, একবার সাহাবীগন রাসূল স. কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি আমাদের সাথে তো রসাত্মক কথাবার্তা বলেছেন! তখন তিনি বললেন, আমি তো সত্য কথাই বলছি।
রাসূলুল্লাহ স. এ উক্তির মাধ্যমে সাহাবা কিরাম স. এর মধ্যে প্রচলিত একটি ভুল ধারণার অপনোদন করেছেন। সাহাবীগণ মনে করতেন, হাসি আনন্দ প্রকাশ কিংবা বৈধ উপায়ে মজা করা রাসূল স. এর জন্যে মোটেও শোভনীয় নয়। তাই তাঁরা রাসূল স. কে কৌতুক করতে দেখে তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি দেখি আমাদের সাথে কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা বলছেন! রাসূল স. তাঁদের ভুল ধারণা দূরিকরণার্থে বললেন, আমি তো সত্য কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা বলি না।
প্রতিদিন কিছু না কিছু ব্যায়াম বা শরীরচর্চা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। ব্যায়ামের মধ্যে হাটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং সাঁতারকাটা ইত্যাদি রয়েছে। যারা নিয়মিত পানিতে সাঁতার কাটে, তাদের হার্টবিট ভালো থাকে। সাঁতার কাটা চিত্ত বিনোদনের একটি মাধ্যম। এতে শরীরের ব্যায়াম যেমন হয়, তেমনি আনন্দ উপভোগ ও করা যায়। সাঁতার কাটলে শরীর পুষ্ট হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সাঁতার কাটা মুবাহ অর্থ্যাৎ বৈধ কাজ। ক্ষেত্র বিশেষ এটি মানুষের জন্যে জরুরী হয়ে পড়ে। সাইয়িদুনা জাবির রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স. বলেন। প্রত্যেক বিষয়ই যাতে আল্লাহর যিকর (স্মরণ) নেই তা- খেলতামাশা হিসেবে গণ্য হবে, তবে চারটি কাজ এর ব্যতিক্রম। তা হলো দুটি লক্ষ্যপানের মাঝে ব্যক্তির হাটা, ব্যক্তির ঘোড়া লালন পালন ও প্রশিক্ষণ দান, স্বীয় স্ত্রীর সাথে আমোদ প্রমোদ করা ও সাঁতার কাটা শিক্ষা দেয়া। সাইয়িদুনা উমার রা. আবু উবাইদা ইবনুল জাররাজ রা. এর প্রতি লিখিত এক চিঠিতে বাচ্চাদেরকে সাঁতার কাটা শিক্ষা দানের নির্দেশ দান করেন।
সুস্থ শরীর ও মনের জন্যে কোনো না কোনো ধরণের শরীরচর্চা প্রয়োজন। পরিমিত ব্যায়াম এবং সে সাথে সুমিতপানাহার হলো শরীর ও মন সতেজ রাখার অন্যতম মাধ্যম। এ ছাড়া অবসর কালক্ষেপণের একটি ভালো উপায় হলো ব্যায়াম করা। আর হাঁটা ও দৌড়ানো হলো একটি সহজ সরল ব্যায়াম। ইসলাম যেহেতু একজন মুমিন ব্যক্তির শারীরিক সুস্থতার প্রতি গুরুত্বরোপ করে, সে কারণে হাঁটা ও দৌড়ানোর বিষয়টিও ইসলামে উপেক্ষিত নয়; বরং এ দুটির মাধ্যমে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা করা ইসলমে সুপ্রমাণিত। এর দ্বারা ইসলাম মানুষকে হাঁটা ও দৌড়ানোর প্রতি উৎসাহিত করেছে। কারণ এর মধ্যমে শরীরচর্চা ও বিনোদন উভয়টিই অর্জিত হয়। রাসূল স.এর সোনালী যুগে আমরা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। সাহাবা কিরাম রা. এর মধ্যে ও এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। উ¤মূল মুমিনীন আয়িশা রা. বলেন তিনি কোনো এক সময় সফরে রাসূল স. এরসাথে ছিলেন, এ সময় একবার আমি রাসূল স. এর হাঁটাহাটি র প্রতিযোগিতা দিয়ে জিতে গেলাম। অতঃপর যখন আমার শরীর মোটা হল তখন তার সাথে প্রতিযোগিতায় তিনি আমার ওপর বিজয়ী হয়ে বললেন, এটা ঐ দিনের প্রতিযোগিতার বদলায়।
ঘোড়ায় আরোহন ও ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা আনন্দ আহলাদ ও চিত্ত বিনোদনের একটি উপায়। এর মাধ্যমে ব্যক্তির শারীরিক ব্যায়াম হয়। ইসলাম এ ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রা. বলেন, নবী করীম স. ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা করিয়াছেন। যেটি জিতেছে, সেটিকে পুরস্কার ও দিয়েছেন। সাইয়িদুনা উমার আঞ্চলিক প্রশাসকদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা তামাদের সন্তানদের সাঁতারকাটা ও তীরন্দাজি শিক্ষা দাও। ঘোড়ার পিঠে লম্প দিয়ে উঠে শক্ত হয়ে বসতে ও তাদের অভ্যস্ত করো। ঘোড়ার মত উটের পৃষ্ঠেও মানুষ আরোহন করে বিনোদন উপভোগ করতে পারে। ইসলামে উটের ওপর আরোহন এবং এর প্রতিযোগিতা দেওয়া বৈধ।রাসূলুল্লাহ স. ও তাঁর সাহাবা কিরাম রা. উটের ওপর আরোহণ করেছেন।
মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি এবং এর প্রতিযোগিতা বিনোদন একটি উপায়। এতে রয়েছে সামরিক প্রশিক্ষণও অনুশীলন, শারীরিক যোগ্যতা অর্জন, ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার দীক্ষা। এ ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত নিয়ম কানুন মেনে চলে একে উপভোগ্য করে তোলা ইসলামে অনুমোদিত। রাসূলুল্লাহ স. নিজেও প্রসিদ্ধ কুস্তিগির রুকানার সাথে কুস্তি করেছিলেন এবং তাকে ধরাশায়ী করেছিলেন। তবে বর্তমান কালে প্রচলিত কুস্তি, যা বিভিন্ন টেলিভিন চ্যানেলে সারাক্ষণ প্রদর্শিত হচ্ছে তা ইসলামে বৈধ নয়। কারণ এতে শরীয়তের বিধান লঙ্গিত হচ্ছে অবলীলায়। যেমন এতে সতর অনাবৃত রেখে খেলা হয়, অন্যেকে প্রচন্ড আঘাত করা হয়, এতে কোনো কোনো সময় অঙ্গহানি ঘটে, অনেক সময় অন্ধত্ব বরণ করতে হয়, কখনো তা মৃত্যুরও কারণ হয়ে থাকে।
প্রাণী শিকার বড় উপকারী এবং কল্যাণময়। এ কাজে যেমন সামগ্রী মেলে, উপার্জন হয়, তেমনি তা ব্যায়াম চর্চাও বটে। আরব ও পৃথিবীতে অন্যান্য জাগিগুলোর বিপুল সংখ্যক লোকই এ শিকার কর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করছে। এজন্যে কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্বরাপোক করা হয়েছে। ফিকহ গ্রন্থ রচয়িতাগন নিজ নিজ গ্রন্থেশিকার বিষয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় প্রণয়ন করেছেন। তাঁরা এর মধ্যে কি হালাল ও কি হারাম, এ ক্ষেত্রে কি ওয়াজিব ও কোনটি মুস্তাহাব তা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইসলাম আনন্দ উপভোগ কিংবা বিনোদনের মানসে প্রাণী শিকার বৈধ নয়। এক্ষেত্রে একজন মুসরিম ব্যক্তির কর্তব্য হলো, আল্লাহর দেয়া পবিত্র বিযক তালাশের নিয়্যাত করে প্রাণী শিকার করা,যাতে তার হালাল উপার্জনের সাথে সাথে আনন্দ এবং চিত্তের বিনোদন ও হয়ে যাবে।
দেশ ভ্রমণ করা মানুষ অনেক অজানা জিনিষের সন্ধান পায় এবং বহুরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ভ্রমণের মাধ্যমে জীবনের একঘুঁয়েমি ভাব দূর করে মানুষ আনন্দ উপভোগ করতে পারে। সাথে সাথে এতে মানুষের জ্ঞানের পরিধি সমৃদ্ধ হয়, মহান আল্লাহর নয়নাভিরাম অপরূপ সৃষ্টিরাজি অবলোকন করে তাঁর অপার শক্তি ও মহানত্ব অনুভব করতে পারে। এভবে মানুষ মহান রবের শুকরিয়া আদাযে সচেষ্ট হয়। দেশ ভ্রমণ করার ফলে মানুষের সরমনে ভেসে উঠে যুগে যুগে অভিশপ্ত জাতি গোষ্ঠীর ভয়াবহ পরিণতির নিদর্শাবলি। আল্লাহ তা’আলা বলেন: তারা কি এ উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা সমঝদার হৃদয় ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে। বস্তুত চক্ষ তো অন্ধ হয় না, কিন্তু অবস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়। চিত্ত বিনোদনের একটি অন্যতম উপায় হলো তীরন্দাজি। ঐতিহাসিক ভাবে তীরন্দাজি মূলত পশু শিকার ও যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে উদ্ভাবন করা হয়। ইসলামে তীর নিক্ষেপণ শরীয়ত সম্মত একটি খেলা ও প্রশিক্ষণমূলক বিষয়। এটা ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল খেলা ও হাস্য কৌতুকের ব্যাপারই নয়; বরং তা হলো শক্তি সামর্থ্য অর্জন, প্রকাশ ও প্রমাণের অন্যতম মাধ্যমও। রাসূল স. যখন সাহাবা কিরামকেতীর নিক্ষেপণ মশগুল দেখতেন, তখন তিনি সর্বোতভবে তাঁদের উৎসাহিত করতেন। রাসূল স. বলতেন তোমরা তীর নিক্ষেপ করো, আমি তোমাদের সকলেরই সাথে আছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন