রফিকুল ইসলাম সেলিম : জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলে যোগ দিতে এখন ঢাকার পথে বৃহত্তর চট্টগ্রামের কয়েক হাজার বিএনপি নেতাকর্মী। ডেলিগেট ও কাউন্সিলর ছাড়াও আগামীকাল শনিবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠেয় ৬ষ্ঠ কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন আরও কয়েক হাজার নেতাকর্মী। অনেকে ইতোমধ্যে ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। বাকিরা আজ শুক্রবারের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাবেন।
দলের দুঃসময়ে এ কাউন্সিলকে ঘিরে এ অঞ্চলের তৃণমূলে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করছে। উজ্জীবিত দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। তৃণমূলের প্রত্যাশাÑ দলের জন্য যাদের ত্যাগ রয়েছে এবং বিগত দিনে যারা রাজপথে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে কাউন্সিলে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। মাঠের লড়াকুদের সামনের কাতারে এনে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ সুগম করবে বিএনপিÑ এমন প্রত্যাশা এখানকার কর্মী-সমর্থকদের।
বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামকে জাতীয়তাবাদী শক্তির ঘাঁটি মনে করে বিএনপি। বিগত দিনে সবকটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে এ অঞ্চলে বিএনপির প্রার্থীরা ব্যাপক বিজয় অর্জন করে। বিএনপি নেতাদের মতে, এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সাথে বিএনপির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সাংগঠনিকভাবে এ অঞ্চলে বিএনপি কখনও তেমন সুসংগঠিত হতে পারেনি। তবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দলটি সবসময় এ অঞ্চলে শীর্ষে অবস্থান করে। নেতৃত্বের মধ্যে দলাদলি, কলহ, বিরোধ থাকলেও কর্মী সমর্থক বিশেষ করে সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে এ বিভক্তি কখনও স্পষ্ট হয়নি। বিএনপির প্রতিটি দুঃসময়ে এ অঞ্চলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই দলের মূলশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এক/এগার পরবর্তী রাজনৈতিক বিপর্যয়ে দলের বড় বড় নেতারা দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে গেলেও মাঠ দখলে রেখেছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ অঞ্চলে বিএনপির অনেক বাঘা বাঘা নেতা কারাবন্দি হয়েছেন। অনেকে গ্রেফতার এড়াতে পাতালে চলে যান। আর ওই সময়ে দলীয় কার্যালয় সরব রাখে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সময়-সুযোগে বুঝে রাজপথেও তারা সরব হয়েছে।
২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামাল দেয়ার আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম-নির্যাতনের কবলে পড়ে দলের নেতাকর্মীরা। সংসদে বিরোধী দল হওয়ার পরও রাজপথে সরব হতে পারেনি দলের নেতাকর্মীরা। নানা অজুহাতে পুলিশি বাঁধা আর বাধা-নিষেধের কবলে পড়ে বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয় দলটি।
একতরফা নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনেও নির্যাতনের স্টীম রোলার নেমে আসে নেতাকর্মীদের উপর। দলের সুবিধাবাদী কিছু চিহ্নিত নেতা ওই কঠিন সময়ে আত্মগোপনে কিংবা সরকারী দলের সাথে আপোষ রফায় আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও মাঠে ছিল তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। পুলিশি হামলা, মামলা, ধরপাকড় আর জেল-জুলুম উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আন্দোলন তীব্র হওয়ার সাথে সাথে তীব্রতর হয় জুলুম-নির্যাতনও। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবন্দি হয়। শত শত মামলায় আসামী হয়ে ঘরবাড়ি ছাড়া ফেরারি জীবনযাপন করে অনেক নেতাকর্মী।
দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলনে নেই বিএনপি। তারপরও শান্তিতে নেই নেতাকর্মীরা। পুরনো মামলায় আসামি ধরার নামে নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে পুলিশি হানা অব্যাহত আছে। একের পর এক মামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীরা মামলা মোকাবেলায় আদালতের বারান্দায় ঘুরছে। আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসংখ্য নেতাকর্মী। আন্দোলন করতে গিয়ে মামলায় আসামী হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যও লাটে উঠেছে অনেকের। এতকিছুর পরও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দলে সক্রিয় রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে বিএনপি। কঠিন সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয় কাউন্সিল। আর তাই এ কাউন্সিলকে ঘিরে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হাজারও নেতাকর্মী আশাবাদী হয়ে উঠছেন। তাদের প্রত্যাশা সম্মেলন আর কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে বিএনপি ফের ঘুরে দাঁড়াবে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জুলুম-নির্যাতনে বিএনপি কাবু হলেও তারা মাঠ ছাড়েনি। বরং দলটির জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। সঠিক নেতৃত্ব সামনে নিয়ে আসতে পারলে এ জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে বিএনপি ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন সে আন্দোলনও সফল হবে বলে মনে করেন তারা।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলেন, বিএনপি জনগণের দল। সৎ, যোগ্য এবং সাহসী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলে বিএনপির পেছনে জনতা কাতারবন্দি হবে। আর তখন যে কোন আন্দোলন সফল হবে এমন প্রত্যাশা তাদের। এদিকে সম্মেলনকে ঘিরে কেন্দ্রে ভাল পদ পেতে মরিয়া এ অঞ্চলের কয়েক ডজন নেতা। দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পদে স্থান পেতে নানা দেন-দরবার, লবিং-তদবির অব্যাহত রেখেছেন অনেকে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, কেন্দ্রে যাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে তাদের অতীত ইতিহাস মূল্যায়ন করা জরুরী। বিশেষ করে গত কয়েক বছরের আন্দোলন সংগ্রামে তাদের ভূমিকা কী ছিল তার চুলছেড়া বিশ্লেষণ করেই কেন্দ্রে তাদের পদ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনা দরকার।
জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলকে একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি উল্লেখ করে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. ইয়াহ্ইয়া আক্তার বলেন, আশা করা যায় কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রমনা নাগরিকের মতো বিদেশী বন্ধুরাও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। এ প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও পৌর নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম সাধারণ ভোটারদের ভোটবিমুখ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইউপি নির্বাচনকে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন এ নির্বাচনেও বিনা ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছে। এতে করে ভোটাররা পুরোপুরি নির্বাচনবিমুখ হয়ে যাচ্ছে, আর তা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবেন এমন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে সে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার একটি শুভসূচনা হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন