আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে : “কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সুন্দরবনের সংকটাপন্ন প্রতিবেশ আরো হুমকির মুখে পড়বে” এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন ভারতীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। সুন্দরবন বাঁচাও রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হঠাও শ্লোগানকে সামনে নিয়ে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির দ্বিতীয় বারের মত সুন্দরবন অভিমুখী লং মার্চও চলতি সপ্তাহে শেষ হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মেগা প্রকল্পটির কর্মকা-। খোদ ভারতীয় পরিবেশবাদীরা বলছেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ভারতের কিছু এলাকার জনসাধারণ ইতোমধ্যে তাদের জীবিকা হারিয়েছে, পরিবেশ নষ্ট হয়েছে এবং এ কারণে আদালত অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তাই জনগণের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা এবং যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। এনভায়রনমেন্ট এন্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ (সিইপিআর), ভারত বিজ্ঞান যাত্রা, দিল্লি সলিডারিটি গ্রুপ, মাচ্ছিমার অধিকার সংঘর্ষ সংগঠন (ম্যাস) ও জাতীয় মৎস্যজীবী ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও উপকূলীয় প্রতিবেশ শীর্ষক এক সেমিনারে পরিবেশবাদীরা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
সূত্রমতে, প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ব্যাপক আলোচিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকা- থেমে নেই। এ নিয়ে অবরোধ, হরতাল, মানববন্ধন, লং মার্চ প্রভৃতি কর্মকা- অব্যাহত থাকলেও ভারতের নির্বাচিত ঠিকাদারকেই কার্যাদেশ দিয়ে প্রকল্পটি যথাস্থানে বাস্তবায়ন করতে সরকার অনড় রয়েছে। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রটিতে ২০১৯ সালে উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্ব ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ও পরিবেশকে বিপন্ন করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এখন আমজনতার গলার কাঁটা। আর সরকারের কাছেও যেন বিষফোঁড়া। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, সরকার প্রকল্পটি যেমন বন্ধ করতে পারছে না, তেমনি বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে সরকারি হিসাবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পোড়ানো হবে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, ছাই, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি আশে-পাশের বায়ু, পানি, মাটিকে দূষিত করবে। এই দূষণ পানি ও বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে বিপন্ন করবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ কয়লা বহনকারী জাহাজ আসা-যাওয়া করবে বনের ভিতর দিয়ে। বহুল সমালোচিত এই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যে শুধু দেশে নয়, ইউনেস্কো-রামসারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে।
খুলনা ও বাগেরহাটের লংমার্চে আয়োজিত সমাবেশে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ বলেন, সুন্দরবন ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৪ কোটি মানুষের ক্ষতি করে ১৩শ’ ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে পারে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের কোন বিকল্প নাই। ভারতের বাতিল প্রকল্পটি আমাদের দেশে এনে বাস্তবায়িত করে সরকার জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে। এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষতি হবে।
বাগেরহাটের লংমার্চ শেষে সমাবেশে ভারতীয় পরিবেশবিদ ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা ভারতে বন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী এনটিপিসি কোম্পানীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। তারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে আমাদের সবুজ প্রকৃতি মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। আর এখন তারা বিশ্ববাসীর গর্ব ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের কারণে এদেশের সুন্দরবন ধ্বংস হলে ভারতের সুন্দরবনও ধ্বংস হবে।
আবার এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার স্মারক। কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎসচিব এই কোম্পানির চেয়ারম্যান। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনটিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
সূত্র মতে, ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ৫ অক্টোবর’১৩ প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র-প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নির্বাচিত হয়েছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (ভেল)।
উল্লেখ্য, ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে উৎপাদিত বায়ু দূষণকারী উপাদানগুলো হলো- ৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রায় ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান। কয়লা পুড়িয়ে ছাই তৈরী হয় এবং কয়লা ধোঁয়ার পর পানির সাথে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য। ছাই এবং এই তরল উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কঠিন ও তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, সংরক্ষণ আধার থেকে চুইয়ে নানানভাবে গ্রাউন্ড ও সারফেস ওয়াটারের সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটায় যার ফলে পানির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ে। এই প্রকল্পে প্রতিদিন কয়লা ধোয়ার জন্য ২৫ হাজার কিউরিক মিটার স্বচ্ছ পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে উত্তোলন করতে হবে। ২৫ বছর এই প্রকল্পের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে, এর পরিণতিতে সুন্দরবন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন