১৩ বছর আগের সুনামিতে বেঁচে যাওয়া একমাত্র মসজিদটি হবে কালের নিদর্শন
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রলয়ঙ্করী সুনামির আঘাতে বিধ্বস্ত ইন্দোনেশিয়ার ‘রহমতুল্লাহ মসজিদে’র ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনঃসংস্কার করতে চাচ্ছে না দেশটির কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে এই মসজদটি সুনামির ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে থাকুক। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উপকূলে সমুদ্রগর্ভে সংঘটিত ভূমিকম্প যে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টি হয়, তা আঘাত হানে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে।
এতে ইন্দোনেশিয়া থেকে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত দু’লাখ ত্রিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। যার মধ্যে শুধু আচেতেই ১,৭০,০০০৷ ইন্দোনেশিয়ার পর আক্রান্ত হয় থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, তারপর ভারত৷ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান এবং নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব যেমন এদিন সংকটাপন্ন হয়, তেমনই দক্ষিণ ভারতেও নেমে আসে মৃত্যুর হাহাকার৷ শুধুমাত্র কুড্ডালোরেতেই হারিয়ে যায় ৮০০ জন৷
ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে মসজিদের ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করতে। যাতে আগত প্রজন্মকে এই ভয়াবহ সুনামি সম্পর্কে জানানো যায়। সুনামির কবল থেকে নাজাত পেয়েছেন মুখতার মাহমুদ দাহলান। তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদুলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সুনামির আগে এই মসজিদটি নির্মানের জন্য এলাকাবাসী প্রচুর প্রচেষ্টা করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মসজিদটির মূল অংশটি নির্মাণ সম্পন্ন করেছি। কিন্তু মিনারটি নির্মাণ করতে পারিনি। সুনামিতে আমরা যে অংশগুলো নির্মাণ করেছি তাতে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। তবে আমরা খুশি যে মসজিদটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পরম সৌভাগ্যের বিষয়।
দাহলান আরও বলেন, এলাকার লোকরা আর্থিক দান সংগ্রহ করে এমন সময় মসজিদটি নির্মাণ করেছেন যখন তারা নিজেরাই অর্থনৈতিক সংকটে ছিলেন। তবে আনন্দের বিষয় হলো, মসজিদটির চারপাশে অবস্থিত সব ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেও মসজিদটি ছিল দাঁড়িয়ে৷
‘রহমতুল্লাহ’ মসজিদটি যে এলাকায় অবস্থিত সেটির বর্তমান নাম হলো তুর্কি লাম্বুক এলাকা। ২০০৫ সালে তুর্কি রেড ক্রিসেন্ট এই এলাকাটিকে পুনর্গঠন করে। তের বছর পর সেই এলাকার খবর জানাচ্ছেন পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক কিরা কে৷
‘ব্যুরো ফর ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টিং’ বা বিআইআর-এর নির্বাহী পরিচালক কিরা কে সুনামির আগে পরে বেশ কয়েকবার আচে গেছেন৷ আনাদুলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সুনামির পর ঐ এলাকায় ব্যাপক পুনর্গঠন কাজ হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, এর ফলে আচে-র গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়েছে – যা একটি ইতিবাচক দিক৷
আনাদুল: দশ বছর আগে সুনামির পর ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা আপনি কেমন দেখেছিলেন?
কিরা কে: সুনামির পর যে আমি আচে-তে গিয়েছিলাম সেটা আমার ঐ অঞ্চলে প্রথম যাওয়া ছিল না৷ আচে-তে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধ কভার করতে ২০০২ সালে আমি সেখানে গিয়েছিলাম৷ সেসময় আচে-র যে অবস্থা আমি দেখেছিলাম সুনামি সেটা পুরোপরি বদলে দিয়েছিল৷
সুনামির দুই সপ্তাহ পর আমি আচে পৌঁছেছিলাম৷ জরুরি সহায়তা হিসেবে যে তৎপরতা চলছিল সেটা ঠিকই ছিল৷ দুর্গতরা খাবার ও আশ্রয় পাওয়া শুরু করেছিল৷ ততদিনে বেঁচে থাকাদের খুঁজে পাওয়ার আশা মিইয়ে এসেছিল৷
আচে-র প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল৷ তখনও নিখোঁজ ছিল আরও প্রায় ৩০ হাজার৷ হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল৷ ভূমির মালিকানা ফিরে পাবার মতো কাগজপত্রও পানিতে ভেসে গিয়েছিল৷
ধ্বংসস্তূপের নীচে মরদেহ পড়ে ছিল৷ মৃতদেহগুলো ক্যারাভানে করে নিয়ে একসঙ্গে গণকবর দেয়া হয়েছিল৷ বিভীষিকাময় সেই সময়গুলোতেও আচে-র মানুষ পুনর্গঠিত হয়ে নতুন জীবন শুরুর কথা ভাবছিল৷
আনাদুল: মনস্তাত্তি¡ক স্তরে কেমন পরিবর্তন চোখে পড়েছে?
কিরা কে: এটা বলা কঠিন৷ সুনামির পর মানুষ যেন ট্রমা (মানসিক আঘাত) কাটিয়ে উঠতে পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল৷ অবশ্য সরকারের কারণে বেশিদিন সেগুলো চলতে পারেনি৷
আচে-র কেউ কেউ আমাকে ট্রমা-র কথা জানিয়েছে৷ অবশ্য অনেকেই বলেছে, শক্ত ধর্মীয় বিশ্বাস তাঁদের দুঃখ ভোলাতে সহায়তা করেছে৷ তাদের মতে, গৃহযুদ্ধটি ছিল ‘মানুষের তৈরি’ আর সুনামি ‘ঈশ্বরের তৈরি’৷
সুনামির পর আচে-র মানুষ বেশি বেশি ধর্ম পালন শুরু করেছে। কারণ তাদের বিশ্বাস, সুনামির মাধ্যমে ঈশ্বর তাদের দুষ্কর্মের প্রতিশোধ নিয়েছে৷ এমন মনে হওয়ার আরেকটি কারণ এই যে, মানুষ দেখেছে সুনামির কারণে গ্রামের আর সব ধ্বংস হয়ে গেলেও অনেক মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল৷ সূত্র : হাফিংটন পোস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন