শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

দুর্নীতি দমনে রাসূল সা.-এর কর্মসূচি

প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মনজুর হোসেন খান

॥ তিন ॥
বিভিন্নপদে স্বজনদেরকে নিয়োগদান, নিজ দলের লোকজনকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধাদান এবং এর মাধ্যমে অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগদান করে। এভাবে অযোগ্য লোকদের নিয়োগদানের মাধ্যমে দেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।
উন্নত দেশে ব্যক্তির বৈষয়িক সম্পত্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার উপর সমাজে স্থান ও মর্যাদা নিরূপিত হয়। আমাদের দেশে সম্পদের স্বল্পতা ও অভাবের কারণে সরকার সকল কর্মীকে পর্যাপ্ত ভাতা প্রদান করতে পারে না। ফলে সে সমাজের লোকজন জীবিকা নির্বাহের জন্য এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ বৈষয়িক ব্যাপারটি দুর্নীতির অন্যতম কারণ।
দুর্নীতির অন্যতম আরেকটি কারণ হলো অর্থনীতি। অভাবে যখন স্বভাব নষ্ট হয় তখন সে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অসৎ পথে আয় করতে চায়। সীমিত আয়, অর্থাভাব, আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয়, সন্তানের খরচ যোগানো ইত্যাদি কারণে দুর্নীতি করে থাকে।
বর্তমান সমাজে এ সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করছে, সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তারা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। ফলে তারা যখন বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে সোনার হরিণ নামক চাকরি পেয়ে যায় আর তারাই আবার দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে অবলীলাক্রমে জড়িয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বেকার সমস্যা। তারপর ভাগ্যের কিংবা মামার জোরে কোনমতে চাকরি হলেও সরকারি চাকরিতে সহনীয় উপযুক্ত ও মানসম্মত বেতন স্কেল ও পদোন্নতি তত সহজ নয়। ফলে খুব সহজেই একজন কর্মকর্তা দুর্নীতিতে আকৃষ্ট হয়।
আরবী ভাষায় একে ফাসাদ বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘ যে সব লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে ফ্যাঁসাদ সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে: তাদেরকে হত্যা করতে হবে কিংবা শূলিবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের নির্বাসিত করা হবে।’’ ‘‘আল-কুরআন, ৫ : ৩৩’’ আরবী জারীমা শব্দকেও এর সমার্থক শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জারীমা অর্থ অপরাধ, পাপ বা আইন বিরোধী শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জারীমা অর্থ অপরাধ, পাপ বা আইন বিরোধী কাজ। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো পৎরসব, ড়ভভবহংব তাছাড়া গড়ৎধষ ফবমবহবৎধঃরড়হ; ধ সধষঢ়ৎধপঃরপব, ধ পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ, ঢ়বৎাবৎংরড়হ (বদমায়িশি), রিপশবফহবংং, ওসঢ়ৎড়নরঃু, ফরংযড়হবংঃু (অসততা), ধ ফরাবৎংরড়হ ভৎড়স ঃযব ঃৎঁব ঢ়ধঃয (সৎ পথ থেকে বিপথে গমন)। যার বিপরীত হলো গড়ৎধষ, গড়ৎধষরঃু ড়ৎ ৎবষধঃরহম ঃড় ঃযব পড়হফঁপঃ ড়ভ সবহ; ঞযব ফড়পঃৎরহব ড়ৎ ঢ়ৎধপঃরপব ড়ভ ঃযব ফঁঃরবং ড়ভ ষরভব. ঙীভড়ৎফ ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু তে বলা হয়েছে, উরংযড়হবংঃ, রষষবমধষ নবযধনরড়ৎ, বংঢ়বপরধষষু ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব রহ ধঁঃযড়ৎরঃু, বষবমধঃরড়হং ড়ভ নৎরনবৎু.
অর্থাৎ ‘‘দুর্নীতি হল অসততা, অবৈধ আচরণ, বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিবর্গের আইন বহির্ভূত আচরণ, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ইত্যাদি’’। দুর্নীতি হলো সমাজে প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরণের অপরাধমূলক আচরণ। সাধারণত ঘুষ বলপ্রয়োগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যক্তি বিশেষকে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণপ্রশাসনের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা অর্জনের নাম দুর্নীতি। রমনাথ শর্মার মতে, ওহ পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ধ ঢ়বৎংড়হ রিষষভঁষষু হবমষবপঃবফ যরং ংঢ়বপরভরবফ ফঁঃু রহ ড়ৎফবৎ ঃড় যধাব ধহ ঁহফঁব ধফাধহঃধমব. অর্থাৎ ‘‘অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলার নাম দুর্নীতি’’। ডড়ৎষফ ইধহশ কর্তৃক প্রদত্ত দুর্নীতির সংজ্ঞা হলো: ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ রং ঃযব ধনঁংব ড়ভ ঢ়ঁনষরপ ঢ়ড়বিৎ ভড়ৎ ঢ়ৎরাধঃব নবহবভরঃ. অর্থাৎ ‘‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার।’’ ঞৎধহপঢ়ধৎবহপু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ (ঞও) এবং ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ চবৎপবঢ়ঃরড়হ ওহফবী (ঈচও) প্রতিবেদনে দুর্নীতি বলতে সরকারি ক্ষমতা ও সুবিধাকে বেসরকারি বা ব্যক্তি স্বার্থে অপব্যবহার এবং সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিকে বুঝানো হয়েছে। ঞৎধহপঢ়ধৎবহপু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ এর সংজ্ঞা হলো: ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ রং ঃযব ধনঁংব ড়ভ ঢ়ঁনষরপ ড়ভভরপব ভড়ৎ ঢ়ৎরাধঃব মধরহ. অর্থাৎ “সরকারি দফতরকে ব্যক্তি স্বার্থে কাজে লাগানো, যেখানে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।” গ. ঔড়যহব এর মতে, ‘‘ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ রং সরংংঁংব ড়ভ ঢ়ঁনষরপ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু, ঢ়ঁনষরপ ৎধহশ ধহফ ংঃধঃঁং ভড়ৎ ঢ়ৎরাধঃব রহঃবৎবংঃ.” দুর্নীতি কেবল সরকারি কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত নয়; বরং সরকারি, বেসরকারি, এনজিও বিভিন্ন পেশা, শ্রেণী, পরিবার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থেও হতে পারে। যেমন, একজন সরকারি কর্মকর্তা অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারেন, যা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হবে অথবা সরকারি বাজেটের টাকা দিয়ে টেন্ডার ছাড়াই কোন কাজ নিজের বা দলীয় লোকদের মাধ্যমে করানো অথবা টেন্ডার দিলেও কাজের মান যথাযথভাবে ঠিক না রেখে কিছু টাকা খরচ করে বাকি টাকা নিজের পকেটস্থ করাও দুর্নীতি হিসেবে গণ্য হবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, দুর্নীতি হলো প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, আইনকানুন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে উদ্ভুত এমন এক পরিস্থিতি যা সঠিকভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত করে। অন্য কথায় দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবৈধ স্বার্থ হাসিল করাকে দুর্নীতি বলে। সভ্যতার প্রথম থেকেই প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রচলন কমবেশি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত প্রশাসনের উৎপত্তির সাথে সাথেই এর প্রচলন ও বিস্তার ঘটতে থাকে। এটি মানুষের ‘ফিতরাত’ তথা স্বভাবের একটি মন্দ দিক। আসমানী কিতাব তাওরাত (ঙষফ ঞবংঃধসবহঃ) এর বিকৃতি ছিল ইতিহাস বিখ্যাত একটি জঘন্য দুর্নীতি। প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে ভারতীয় রাজতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য (কধঁঃরষুধ) তাঁর প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্র (অৎঃযধংযধংঃৎধ) গ্রন্থে দুর্নীতির বিষয়টি আলোকপাত করেছেন। প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে দান্তে (উহঃব) ঘোষণা করেন, আইন বহির্ভূত কর্ম সম্পাদন কিংবা স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাউকে প্রভাবিত করার জন্য ঘুষ-উৎকোচ প্রদানকারীর অবস্থান হলো নরকের সর্বনিম্ন স্তরে। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর কোন একটি নাটকে দুর্নীতিকে বিখ্যাত চরিত্রে রূপায়ন করেছেন। আমেরিকার সংবিধানে ঘুষ উৎকোচ এবং প্রতারণামূলক কর্মকা-কে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যে অপরাধ সম্পাদনের কারণে সেখানকার প্রেসিডেন্ট ইম্পিচম্যান্টের যোগ্য হতে পারেন। ১৭৭৫ সালে ভারতবর্ষের ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং মীরজাফরের পতœীকে দেড় লক্ষ টাকা উৎকোচ দেয়ার বিনিময়ে মুর্শিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যে নিযুক্তি লাভ করেন। অবশ্য এজন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তাঁকে গভর্নরের পদ থেকে ইম্পিচ করেন। সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮২৮ সালে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা যাচাইয়ের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (অঈজ) গ্রহণের নিয়ম প্রচলন করেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৫৭ সালে এদেশে দুর্নীতি দমন ব্যুরো গঠন করে দুর্নীতি প্রতিরোধের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধানের অধীনস্থ দফতরে পরিণত হওয়ায় এ ব্যুরো তার কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন