শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উপক‚লীয় এলাকার দেড় কোটি মানুষ চরম দূর্যোগ ও বিভীষিকার কথা স্মরণ করে আজও আঁতকে ওঠে
উপক‚লীয় ৭১০ কিলোমিটার এলাকার দেড় কোটি মানুষের কাছে বিভীষিকাময় ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ। ১৯৭০-এ ১২নভেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’ প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস নিয়ে আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপক‚লের ১০টি জেলার বিশাল জনপদে হামলে পড়েছিল। ভয়াল ওই রাতে উপক‚লীয় জেলাগুলোর প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় হেরিকেন। ঐ ঝড়ের কালো রাতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ প্রথমে নিখোঁজ থাকলেও পরে আর তাদের কোন সন্ধান মেলেনি। ফুসে ওঠা বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছাস লক্ষাধীক মানুকে সমুদ্রের অতলে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা চলে যায় না ফেরার দেশে। ’৭০-এর ১২ নভেম্বর হেরিকেন-এর আঘাতে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা ও নোয়াখালীর উপক‚লভাগের প্রতিটি পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিহত বা নিখোঁজ হন।
উপক‚লের ৭১০কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সে রাতে যে ভয়াবহ বিভীষিকা নেমে এসেছিল তার নজির এখনো গোটা বিশ্বে বিরল। তাই নভেম্বর এলেই গোটা উপক‚লীয় এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে থাকেন। ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর রাতেও হেরিকেন-এর অনুরূপ আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বঙ্গোপসাগর থেকে বিশাল জলোচ্ছাস মাথায় করে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে এসে বরিশাল, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের বিশাল এলাকাকে লন্ডভন্ড করে দেয়। তবে ঘূর্ণিঝড় হেরিকেন-এর নির্মম অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে তোলা রেড ক্রিসেন্ট-এর ‘ঘূর্ণিঝড় প্রন্তুতি কর্মসূচি-সিপিপি’র অর্ধ লক্ষাধীক সেচ্ছাসেবী উপক‚লবাসীকে সময়মত সতর্ক করা এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্র্রয় কেন্দ্র সহ বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ফলে সিডর-এ প্রাণহানী আশাতীতভাবে হৃাস করা সম্ভব হয়। কিন্তু সিডর-এর তান্ডব এবং ক্ষয়ক্ষতিও ছিল হেরিকেন-এর অনুরূপ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানা জুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গীনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংগ বঙ্গোপসাগরও। প্রকৃতির সাথে বঙ্গোপসাগরের বিচিত্র লীলার যে ভয়ঙ্কর রূপ, তার অস্তিত্ব অনুভব করতে গিয়ে বাংলাদেশের উপক‚লবাসীকে বার বারই চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ পরবর্তি পর্যায়ে যা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধরে ছোবল হানে। সে প্রকৃতির তান্ডব এদেশের উপক‚লবাসীকে বার বারই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এমনকি প্রকৃতির এ রুদ্র লীলায় আজ পর্যন্ত দেশের উপক‚লভাগের কত মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে তার কোন সঠিক হিসেবও নেই। একইভাবে প্রকৃতির তান্ডবে উপক‚লবাশীর সম্পদের ক্ষয় ক্ষতির সীমাও অপরিসীম। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় বার বারই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তির কারণ ও এর গতিপথ নির্ণয় করা সম্ভব হলেও নিয়ন্ত্রণ আজো মানুষের সাধ্যের বাইরে। তবে সময়মত সতর্ক করার ফলে প্রাণহানীর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি টেকশই অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও কিছুটা হৃাস করা সম্ভব হলেও দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক‚লীয় কৃষি ব্যবস্থা এখনো প্রকৃতি নির্ভর । আর সে প্রকৃতি, কৃষি নির্ভর উপক‚লের অর্থনীতিকে বারবারই বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ফলে ক্ষুধা আর দারিদ্রতা দক্ষিণ উপক‚লবাসীর পিছু ছাড়ছে না।
১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর কালো রাত্রীর সে বিভীষিকা আজো উপক‚লের বয়োজেষ্ঠদের তারা করে ফিরছে। তবে স্বজনহারা সব বয়েসী মানুষ বড় দুঃসহ জাতনা নিয়েই স্মরন করছেন ভয়াল ১২ নভেম্বরকে। আজ হেরিকেন-এর ছোবলে নিহতদের স্মরনে ভোলাসহ উপক‚লীয় বিভিন্ন এলাকায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। ১২নভেম্বরের হেরিকেনের তান্ডব গোটা উপক‚লের শত শত মাইল যুড়ে শুধু বিধ্বস্ত জনপদে লাশের মিছিল আর জনবসতীর ধংসস্তুপের চিহ্ন রেখে যায়। হাজার হাজার মানুষ আর গবাদী পশুর মৃতদেহ, আর তার পচা গলা দূর্গন্ধে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবনকেও অনেকটাই দূর্বিষহ করে তুলেছিল। তাদের পারনে ছিলনা কাপড়, পেটে ছিল খাবার। ছিলনা মাথা গোজারও কোন ঠাঁই। ফলে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে।
তারপরেও প্রকৃতির একের পর এক রুদ্র রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া উপক‚লের মানুষগুলো প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই টিকে আছে আজো উপক‚লের জনপদে। তবে ’৭০-এর সেই স্মৃতি নিয়ে এখনো যারা বেঁচে আছেন, তাদের সকলকেই আজো তাড়া করছে ভয়াল সে স্মৃতি। এমনকি সে রাতে ভয়াল হেরিকেনের তান্ডবের শিকার নিকটজনের লাশও খুঁজে পায়নি হাজার হাজার পরিবার। পরিপূর্ণ ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল দেশের পুরো উপক‚লীয় জনপদ।
তবে ঐ দূর্যোগের পরেও পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাষক ঘূর্ণি উপদ্রæত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শনে এসেছিলের ১০দিন পরে। ততদিনে গোটা বিশ্বের গণমাধ্যম সরেজমিনে হেরিকেনের তান্ডবের খবর বিস্তারিত প্রচার করেছিল। বিশ্ব বিবেক পাকিস্তানের সামরিক শাষকদের ঐ অমানবিক আচরনেরও ধিক্কার জানায়। ঘূর্ণিঝড়ের পর পরই বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান ও মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ভোলাসহ ঘূর্ণি উপদ্রæত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ান। দলীয় নেতা কর্মীদের নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপড়তায় অংশ নেন ঐ দুই নেতা ।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সহ গোটা পাকিস্তানের সর্বাধিক অনুন্নত দারিদ্র পীড়িত উপক‚লীয় এলাকা প্রকৃতির রুদ্ররোশে আরো একবার বিপন্ন হবার পরে অবশিষ্ট ছিল শুধু সাগরের গর্জন এবং মানুষ আর গবাদী পশুর সব মিছিল। আর বিভৎস ধংসস্তুপ থেকে ভেসে আসছিল স্বজনহারাদের কান্নার রোল। মরদেহের পঁচাগলা গন্ধে পুরো উপক‚লীয় এলাকাই চরম মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। পানি, খাবার আর বসনের অভাবে উপক‚লের বেশীরভাগ এলাকার বাতাসই দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের ল²ীপুর সংবাদাতা জানান, স্মরণকালের ভয়াবহতম এই দুর্যোগে উপকূলীয় জেলা ল²ীপুরের রামগতি ও বর্তমান কমলনগর উপজেলায় সৃষ্টি হয় চরম দুর্যোগময় পরিস্থিতির। লন্ডভন্ড হয়ে যায় সব কিছু। মেঘনা নদীর উত্তাল ঢেউয়ের প্রবল স্রোতের টানে ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ, গবাদি-পশু, ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা ও সম্পদ। বিলীন হয়ে যায় দুই উপজেলার বেড়িবাধসহ অনেক জনপদ।
চারিদিকে লাশ-আর-লাশ, লাশের গন্ধে মানুষ কাছে যেতে পারেনি। ৩-১০ ফুটের জলোচ্ছাসের কারণে মাটি দেয়া যায়নি মৃত মানুষগুলোকে। সেই দিনের ভয়াবহ দুযোর্গের কথা মনে পড়লে আজও এলাকার সাধারন মানুষের মন ও পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। আঁতকে উঠে উপকূলীয় এলাকার মানুষগুলো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন