শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মরা খালে পরিণত নদ-নদী - জীবন-জীবিকায় সঙ্কট

প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : ‘বছর বিশেকের ব্যবধানে নদ-নদী পরিণত হয়েছে খালে। এই যে দেখছেন প্রায় নদীর পাড় পর্যন্ত পানি থৈ থৈ করত। ছিল জোয়ার-ভাটা। এখন পানি পাওয়া যায় না তলানীতেও। কি যে হলো আস্তে আস্তে নদী মরে যাচ্ছে। নদ-নদীর চেহারা দেখলে যে কারো মায়া হবে, কষ্ট লাগবে। কষ্ট লাগে না কেবল ভারতের। ভাটির দেশ বাংলাদেশকে ভারত পরিকল্পিতভাবে মরুভূমি বানাচ্ছে। তবুও কোনো প্রতিবাদ নেই। গানের কলির মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার বলার কিছুই ছিল না পরিস্থিতি এমনই। কতটা ভয়াবহ অবস্থা তা শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীর দিকে তাকালে পানি দেখা যায় না। তবে চোখে পানি আসে।’ এক সময়ের প্রমত্তা কুমার নদের অবস্থা দেখিয়ে কথাগুলো শোনালেন ঝিনাইদহের শৈলকুপার ব্যবসায়ী আফসার আলী। গাড়াগঞ্জ পয়েন্টে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে আরো বললেন, একদিনের ব্যাপার নয়, বছরেরর পর বছর ধরে করুণ অবস্থা হচ্ছে নদ-নদীর। কিন্তু কোনোকিছুই করা যাচ্ছে না। চোখের সামনে নদ-নদী মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটছট করছে। এ দৃশ্য তো দেখা যায় না। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন জোরালোভাবে লেখালেখি করেন, বারবার লেখেন, মানুষকে প্রকৃত চিত্র জানান। শুধু কুমার নদ নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমের সব নদ-নদীর অবস্থা শোচনীয়।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী ও খাল-বিলের প্রকৃত অবস্থা সরেজমিন দেখার সময় বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। জেনেছি নদী নিয়ে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ। সবাই একই সুরে বলেছেন, নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। খাল-বিলেও পানিশূন্য অবস্থা। এতে সৃষ্টি হচ্ছে জীবন-জীবিকায় মারাত্মক সঙ্কট। ঝিনাইদহ ক্যাসেল ব্রিজ পার হওয়ার সময় দেখা গেছে, নবগঙ্গার বেহাল অবস্থা। নদীতে আগের মতো ঝাঁপ দিয়ে গোসল করার প্রতিযোগিতা চলে না। কুষ্টিয়া লালন শাহ সেতু ও পাশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পানিশূন্য অবস্থা। আসলেই পদ্মা দিয়ে পানি আসছে চুইয়ে। গঙ্গানির্ভর সিংহভাগ নদ-নদী দিনে দিনে পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদীদেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। কোনো প্রাণ নেই। কোনো কোনো নদী মারাত্মক অস্তিত্ব সঙ্কটে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর হৃদপি- পদ্মা এখন স্পন্দনহীন প্রায়। হেঁটে এখন বিশাল পদ্মা পার হওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। মাঝখান দিয়ে সরু খাল ও নালার মতো কোনোরকমে চুইয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পদ্মার শাখা নদ-নদী মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, নবগঙ্গা এবং অভিন্ন ইছামতি ও কোদলাসহ সব নদ-নদী মরা খালে পরিণত হচ্ছে দ্রুত। এমনিতেই গঙ্গা নদীর ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর নদী ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে দিনে দিনে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। নদ-নদীর চেহারা বলে দিচ্ছে কতটা ভয়াবহ। ইতোমধ্যে এক সময়ে প্রমত্তা ও ¯্রােতস্বিনী ভৈরব, চিত্রা, মুক্তেশ্বরী ও নবগঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি নদ-নদী বিভিন্ন পয়েন্টে শুকিয়ে খাল ও পুকুরে পরিণত হওয়ায় সেখানে চাষাবাদ ও মাছ চাষ হচ্ছে। শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীর দুই পাড় হয়ে যাচ্ছে দখল। যে যার মতো নদ দখল করে চাষাবাদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পৈতৃক সম্পত্তির মতো ভোগ করছে, অথচ দেখছে না কেউ। নদীপাড়ের বয়োবৃদ্ধ কয়েকজন ব্যক্তি আক্ষেপ করে বললেন, চোখের সামনে নদীগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, কারোরই কিছু করার নেই। আমাদের নদ-নদী আবার কি কোনোদিন বাঁচার মতো বাঁচবে? না ধুঁকে ধুঁকে একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে?
নদী বিশেষজ্ঞদের কথা, মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকা-, সভ্যতা-সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে নদ-নদীর ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও নিবিড়। মাটি ও মানুষের স্বার্থে নদী বাঁচানোর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার হলেও সবচেয়ে এটি অবহেলার শিকার হয়েছে বরাবরই। কৃষি, শিল্প, বনজ, মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা সেচ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট), বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ও নওয়াপাড়া নদীবন্দরের অবস্থা করুণ হয়ে পড়ছে ক্রমেই। পদ্মায় পানি না থাকায় শাখা নদ-নদী তো মরা খালে পরিণত হচ্ছেই তাছাড়া যেটুকু অস্তিত্ব আছে প্রভাবশালীরা গলা টিপে সেটুকু শেষ করছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কোন নদী, কারা কিভাবে গলা টিপে মারছে নিজেদের স্বার্থে তা কখনোই সরকারিভাবে তদন্ত করা হয় না।
এ অঞ্চলের প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভরশীল মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ইছামতি, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গাসহ পদ্মার শাখা-প্রশাখা এবং অভিন্ন নদ-নদীর ওপর। পানি প্রতিবন্ধকতায় নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। ঘটছে ষড়ঋতুর পরিবর্তন। গরপড়তা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে মরুকরণ প্রবণতা। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে পরিবেশবিদরা উদ্বিগ্ন। তাদের কথা, মারমুখী ও বিপজ্জনক হচ্ছে পরিবেশ। এতে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে সেচনির্ভর বোরো আবাদ নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
পানি নিয়ে তথ্য জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারণ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও হাইড্রোলজি বিভাগ এখন একরকম বিরক্ত হয়। তাদের সাফ কথা শুষ্ক মৌসুমে পানি সঙ্কট তো থাকবেই। সুত্র বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ পানি সঙ্কট দেখা দেয় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ভূপৃষ্ঠে পানি পাওয়া হয় কঠিন। এবারও তার ব্যতয় ঘটেনি। ভূপৃষ্ঠে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাটির তলার পানি সম্পদের ওপর প্রচ- চাপ পড়ছে। নতুন নতুন এলাকা গ্রাস করছে লবণাক্ততায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের তিন সহস্রাধিক কিলোমিটার নদীপথের দেড় সহস্রাধিক কিলোমিটার একেবারে শুকিয়ে গেছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর পাড় দখল করে যে যার মতো চাষাবাদ করছে। ঝিনাইদহের নবগঙ্গা, কালীগঞ্জের চিত্রা, নড়াইলের মধুমতি, যশোরের ভৈরব, মুক্তেশ্বরী, ইছামতি ও মাগুরার নবগঙ্গাসহ সব নদ-নদীর অবস্থা সবখানেই প্রায় একই। নদ-নদী স্রোতহীন কিংবা শুকিয়ে যাচ্ছে। মানচিত্র থেকে অনেক নদীর নাম মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সংশিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সারাদেশের ৩৭ শতাংশ এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভরশীল পদ্মা ও গড়াইয়ের শাখা নদী মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ইছামতি, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা ও অভিন্ন নদী ইছামতি ও কোদলাসহ অর্ধ শতাধিক নদ-নদীর ওপর। নদ-নদী বাঁচানো এবং জীবন-মরণ সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে এর আগে অসংখ্যবার তাগিদও দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতীতের মতোই জীবন-মরণের গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি ‘ওভারলুক’ করেছে। পদ্মার শাখা মাথাভাঙ্গা নদীর বৃত্তকার বাঁক থেকে ভৈরব নদের উৎপত্তি। ভৈরব নদ কোটচাঁদপুর, বারোবাজার, বারীনগর, যশোর, শিল্পশহর নওয়াপাড়া হয়ে চলে গেছে খুলনায়। ভৈরব নদকে ঘিরেই যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনা শহর গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠিত হয় শিল্প কলকারখানা। নদ-নদীকে ঘিরেই মূলত কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য ও বনজ সম্পদ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। রক্ষা হয় পরিবেশ। সবকিছুতেই বড় ধাক্কা পড়ছে নদ-নদী প্রায় পানিশূন্য হওয়ায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন