শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার হরতাল ডেকেছে প্রগতিশীল বামদলগুলো

সাত বছরে আটবার বাড়লো বিদ্যুতের দাম, বিদ্যুতের ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ৭:৪৪ পিএম

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত আটবার বাড়ানোর হল বিদ্যুতের দাম। সাধারণ ভোক্তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।নতুন এ হার কার্যকর হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে। তবে পাইকারি ক্ষেত্রে দাম বাড়বে না। দরিদ্র গ্রাহকদের (লাইফ লাইন) ক্ষেত্রে দাম বাড়বে। তবে এত দিন তাদের যে ন্যূনতম বিল (মিনিমাম চার্জ) দিতে হতো, সেটা আর থাকবে না। মিনিমাম চার্জ তুলে দেওয়ার ফলে ৩০ লাখ দরিদ্র গ্রাহক উপকৃত হবে। আর সাত লাখ লাইফ লাইন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়বে বলে জানান বিইআরসি। পাইকারি ক্ষেত্রে দাম না বাড়ার কারণ, সরকার সেখানে ভর্তুকি দেবে। তাতে বছরে ৩৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে প্রমাণ হল গণশুনানি অর্থহীন বলে জানিয়েছে ক্যাব।
এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে আগামী ৩০ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) আধাবেলা হরতাল ডেকেছে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। আটটি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত এ জোট গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তোপখানা রোডে নিজ কার্যালয়ে সভা শেষে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩৫ পয়সা বাড়ানোর প্রতিবাদে ৩০ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করেছে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণের খরচ বাড়ায় বিদ্যুতের খুচরা পর্যায়ে মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এ বিল ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর হবে। তবে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) দাম বাড়ানো হয়নি। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জানাগেছে, ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত আটবার বাড়ানোর হল বিদ্যুতের দাম। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল। তাতে মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়ে ২০ টাকা ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারে খরচ বাড়ে কমপক্ষে ৩০ টাকা। চলতি বছর মার্চে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছিলেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করা প্রয়োজন। এরপর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গত সেপ্টেম্বরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে শুনানির আয়োজন করে। সেখানে পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব আসে। এর মধ্যে ডিপিডিসি গ্রাহক পর্যায়ে ৬.২৪ শতাংশ, ডেসকো ৬.৩৪ শতাংশ, ওজোপাডিকো ১০.৩৬ শতাংশ, আরইবি ১০.৭৫ শতাংশ এবং পিডিবি ১৪.৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, গণশুনানি করার পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানাতে হয়। এবারও শুনানিতে বিতরণ সংস্থাগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয় ভোক্তাদের পক্ষ থেকে। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষ থেকে দাম কমানোর একটি প্রস্তাব নিয়েও শুনানি হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে হরতাল দিয়ে তার প্রতিবাদ জানানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল বাম দলগুলো। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হলো। বিইআরসির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খুচরা পর্যায়ে গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুতের ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে মাসে ৫০ ইউনিটের কম ব্যবহার করেন এমন প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহকের ( মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশ) বিদ্যুৎ বিল কমবে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের ( মোট গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ) মাসিক বিল মোটেও বৃদ্ধি পাবে না বলেও বিইআরসির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। বিইআরসির সদস্য মো. মিজানুর রহমান জানান, যদি কোনো গ্রাহক বিদ্যুৎত ব্যবহার না করে তাহলে তাকে ২৫ টাকা বিল দিতে হবে। আগে যেটা ১০০ টাকা দিতে হত। এছাড়াও নির্মাণ কাজে বিদ্যুতের ব্যয় ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। আর বিদ্যুতের এ দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের ১৭শ’ কোটি টাকা আয় বাড়বে। এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো আগে হরতাল দিয়ে তার প্রতিবাদ জানানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাম দলগুলো। বুধবার এক সমাবেশ থেকে সরকারকে এই হুঁশিয়ারি দেন সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নতারা। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের প্রতিবাদ এবং নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে এদিন জেলায় জেলায় কর্মসূচি পালন করে বাম দলগুলো।
নি হয়।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা এম শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন,এবারও দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে তারা বলল- সবকিছুরই দাম বাড়ে তেমনি বিদ্যুতেরও দাম বাড়ানো হয়েছে। আর গণশুনানি অকার্যকর ও অর্থহীন প্রতীয়মান হল, গণশুনানি এক ধরনের প্রহসন। শামসুল আলম বলেন, সেখানে আয়-ব্যয় সমন্বয়ের জন্য দাম না বাড়িয়ে বরং এক পয়সা থেকে ৬ পয়সা পর্যন্ত দাম কমানো যেতে পারে। যার কিছুটা মেনে নেন পিডিবির কর্মকর্তারা। বিদ্যুতের উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালনে অযৌক্তিকভাবে’ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে তারা কেউই যৌক্তিক প্রমাণ করতে পারেনি। তারপরও মূল্য কি করে বাড়ে? এটা কেবল আমাদের মতো দেশের প্রেক্ষাপটেই সম্ভব, এর সাথে ন্যায়-নীতি, ভোক্তাদের স্বার্থ-অধিকার ও আইনের কোনো সম্পর্ক নেই।
এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ৩০ নভেম্বর আধাবেলা হরতাল ডেকেছে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তোপখানা রোডে নিজ কার্যালয়ে সভা শেষে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, ইউনাইডে কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য আব্দুস সাত্তার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল্লাহ ক্বাফী রতন, বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা মানসদ নন্দী, ফখরুদ্দিন কবির আতিক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক মনির উদ্দিন পাপ্পু।
নেতৃবৃন্দ বলেন, গণশুনানিকে উপেক্ষা করে মালিক-আমলাদের স্বার্থরক্ষায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির একতরফা ঘোষণা অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী। অবিলম্বে বিদ্যুতের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করতে হবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করার জন্য আগামী ৩০ নভেম্বরের হরতালে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। এদিকে বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এক বিবৃতিতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ইতোপূর্বে সাতবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে, বর্তমান বৃদ্ধি নিয়ে মোট আটবার দাম বাড়ালো। মূল্যবৃদ্ধির ফলে এর কুপ্রভাব বাড়ি-ভাড়া থেকে শুরু করে কৃষি, সেচ ও সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাবে। যা জনজীবনে দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে আনবে। তিনি বলেন, গণশুনানিতে বিইআরসি, ভোক্তা সংগঠন ক্যাব ও বাসদসহ বামপন্থী দলগুলোর মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে দেয়া বক্তব্যের বিপরীতে কোনো যুক্তি দিতে পারে নাই কমিশন। তারপরও রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মাধ্যমে কতিপয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর মুনাফার স্বার্থে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা বিইআরসির গণশুনানিকে আবারো গণতামাশা বলে প্রতীয়মান করল। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপাদান জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কমে গেলেও বাংলাদেশে তা কমানো হয়নি। বিদ্যুতের জন্য আমদানি মূল্যে জ্বালানি সরবরাহ এবং ভর্তুকির টাকাকে ঋণ হিসেবে দেখিয়ে সুদ ধার্য না করলে বিদ্যুতের দাম কোনো ক্রমেই বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না বলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এবং পিডিবি’র চেয়ারম্যান বলেছিলেন। তারপরও আমদানি মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা তাহলে কার স্বার্থে- দেশবাসী তা জানতে চায়। তিনি বলেন, এমনিতেই চাল, ডাল, তেল, নুন, পিয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত। এরপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা মরার উপর খাড়ার ঘা’র সামিল।
এদিকে আবারও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেছেন, ব্যর্থ ও জুলুমবাজ সরকার নিজেদের লুটপাটকে নির্বিঘ্ন করতেই সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আবারো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করে না। গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব পড়বে সর্বত্র। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন পাগলা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। সিন্ডিকেটের হাতে সব কিছু জিম্মি। এ সরকার ক্ষমতায় আসর পরে বছরে বছরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করছে।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন