কারওয়ান বাজারের বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে দিয়ে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছিল কৃষ্ণা। কথা আছে বলে থামিয়ে দিতেই চোখেমুখে বিরক্তি। এগিয়ে এসে বলল, কি তাড়াতাড়ি বলো। ডাক্তারখানায় যাব। ক’দিন যাবৎ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। জানতে চাইলাম কোথায় যাবে? পান্থপথে একজন ডাক্তারের চেম্বারে। ওখানে কেন, ঢাকা মেডিক্যালে যাও? না, ওখানে যাব না। ওখানের লোকগুলো এমন আচরণ করে, যেন আমরা অন্য গ্রহ থেকে নেমে এসেছি! আমরাও তো মানুষ, যাই। ফের থামালাম। অনুরোধ করলাম কেন এমন কথা বলছ? দেখছ না আমরা হিজড়া। এটাই আমাদের অপরাধ। আর দশটা মানুষের মতো চিকিৎসাসেবা নেয়ার অধিকার আমরা পাই না।
কৃষ্ণা জানায়, চেম্বারেও রয়েছে বিড়ম্বনা। সিরিয়াল দেয়া নিয়ে অ্যাটেনডেন্টদের অনীহা, ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে না দেয়ার বিষয় তো আছেই। কোনোভাবে চেম্বারে গেলেও ডাক্তাররা কোনো পরীক্ষা না করেই ওষুধ দিয়ে দেন। আবার ডাক্তারের ‘ফি’ কিছুটা কম দিলে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়াসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয় হিজড়াদের। আর তাই চিকিৎসকদের কাছে না গিয়ে ‘ফার্মেসি’ থেকেই অধিকাংশ সময় ওষুধ ক্রয় করে সেবন করার কথা জানালেন কৃষ্ণা। ক্ষোভের সঙ্গে কৃষ্ণা বলেন, সরকারের কাছে আমাদের দাবি, হিজড়াদের জন্য হাসপাতালে যেন একটি আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়।
হিজড়াদের অধিকার আদায়ে কাজ করেন, এমন একজন হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য সামিউল আলীম শাম্মী। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, হাসপাতালের মতো ডাক্তারের চেম্বারেও হিজড়াদের বিপাকে পড়তে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিজড়াদের ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে দেয়া হয় না। শাম্মী বলেন, আমাকেও ডাক্তার না দেখিয়ে অনেক সময় ফেরত আসতে হয়েছে। আর চেম্বারে গেলেও ডাক্তাররা কোনো পরীক্ষা না করেই ওষুধ দিয়ে দেন। আর তাই অধিকাংশ সময়ই শেষ আশ্রয়স্থল ফার্মেসি। সেখান থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ কিনে খেতে হয়।
প্রান্তিকতারও প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা অধিকাংশ হিজড়ার বসবাস নোংরা বস্তিতে। শরীরের অসম্পূর্ণতা তাকে যতটা না অসহায় করেছে, তার চেয়ে বেশি অসহায় জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনীয় ওষুধ আর চিকিৎসার অভাবে।
সরেজমিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অবস্থিত হিজড়াদের ডেরায় (বাসস্থান) আলাপ হয় নীলিমা, সবিতা, শিরিনসহ বেশ ক’জনের সঙ্গে। এ সময় দেখা যায়, অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশে তাদের বসবাস। সব সময় নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে পেটের অসুখ, সর্দি, কাশি, চর্মরোগসহ নানাবিধ রোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। কৃষ্ণা ও শাম্মীর মতো তাদেরও একই অভিযোগ। তারা জানায়, অসুখ নিয়ে চেম্বারে গেলে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়, ফি’র টাকা আছে তো? কিছুটা কম দিলে চিকিৎসক দেখতে চান না। আবার নানা ধরনের কট‚ক্তি, স্বাভাবিকভাবে কথা না বলা এবং তাড়িয়ে দেয়ার বিষয় তো আছেই। ডাক্তারদের হাতে-পায়ে ধরে চিকিৎসা নিতে হয়। আর তাই নীলিমা, সবিতা, শিরিন, কৃষ্ণা, শাম্মীসহ হাজারো হিজড়া চিকিৎসকদের কাছে যেতে চায় না। ফার্মেসির লোকজনই তাদের ভরসা। সব শুনে ফার্মেসির প্রশিক্ষণহীন-স্বল্প প্রশিক্ষিত লোক যে ওষুধ দেন, তাই ভাগ্য বলে সেবন করে তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসাসেবা কখনোই লিঙ্গ বা সমাজের অবস্থাভেদে নির্ধারিত হয় না। সামাজিক গোঁড়ামিই চিকিৎসাসেবার মতো মানবিক অধিকার থেকে অস্পৃশ্য করে রেখেছে তাদের। তাদের মতে, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও যৌন আচরণের ফলে বিভিন্ন রোগ এবং ভয়াবহ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি এই জনগোষ্ঠীর। সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার পরও এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় যৌন সংখ্যালঘু এ স¤প্রদায় স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যার কারণে তারা মানবেতর জীবনযাপন করতেও বাধ্য হচ্ছেন। হিজড়া জনগোষ্ঠী যাতে স্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা পায় সে বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তারা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, একজন হিজড়ার চিকিৎসায় অনাগ্রহ দেখানো কিংবা ব্যাঘাত সৃষ্টি করার সুযোগ চিকিৎসকের নেই। সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর সাদেকা হালিম বলেন, ‘সমাজে আমরা হিজড়াদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে তাদের আরো ছোট করে দেই। এসবের ফলেই এ ব্যাপারগুলো আরো বেশি ঘটছে’।
হিজড়া স¤প্রদায়ের স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মো: ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, ‘সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন নাগরিক হিসেবে তাদের সব অধিকার রয়েছে এ দেশে। এমনকি সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদেও রয়েছে একজন নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে আর ২৭, ২৮, ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার অধিকার রয়েছে সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার। সে হিসেবে অন্য সবার মতো হিজড়া স¤প্রদায়ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেটে ঝর্ণা ফার্মেসির মালিক সুমন আহমেদ বলেন, ফার্মেসিতে ওষুধ নিতে এলে হিজড়ারা কখনোই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) নিয়ে আসে না। তাই অনেক সময় তাদের কাছে ওষুধ বিক্রি করা হয় না। তবে অধিকাংশ হিজড়াই ব্যথা, জ্বরসহ সাধারণ রোগের ওষুধ নিতে আসে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রির নিয়ম না থাকায় মানবিক কারণে অনেক সময় ওষুধ বিক্রি করি।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা প্রাপ্তি বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার উম্মে ফারহানা জারিফ কান্তা বলেন, সোসাইটিসহ কয়েকটি উন্নয়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফ থেকে হিজড়াদের জন্য এইডস, এসটিডিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। আর সরাসরি কিভাবে অ্যাডভোকেসি লেভেলে কাজ করা যায়, সে বিষয়েও আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছি।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে কাজ করা বন্ধুর একজন কর্মী হিসেবে তিনি মনে করেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তাদের মৌলিক অধিকার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের সচেতন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে সরকারি হাসপাতাল/কমিউনিটি ক্লিনিকে হিজড়াদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের নিরাপদ ও নিশ্চিত সুযোগ রাখতে হবে। এছাড়া শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচিতে যৌন সংখ্যালঘুদের বিষয়টিকে যুক্ত করা উচিত। একই সঙ্গে হিজড়াদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে হিজড়াদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলেও মনে করেন উম্মে ফারহানা জারিফ কান্তা।
চিকিৎসকরা হিজড়াদের কেন স্বাভাবিকভাবে দেখেন না- জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম ইনিকলাবকে বলেন, অন্য রোগীদের মতো আমি হাসপাতাল এবং চেম্বারে হিজড়াদের রোগী হিসেবে চিকিৎসাসেবা দেই। অন্যরা কি করছে জানি না, তবে তাদের পৃথক করার সুযোগ নেই। ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, হিজড়াদের সাধারণ জেনেটিক্যাল এবং হরমোনজনিত সমস্যা থাকে। শুধু হরমোনজনিত সমস্যা থাকলে তা অনেকটা দূর করা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে কম বয়সে চিকিৎসার জন্য আসতে হবে। কিন্তু হিজড়াদের অধিকাংশই বেশি বয়সে চিকিৎসার জন্য আসে। তখন খুব একটা পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না।
সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, মূলধারার সকল চিকিৎসাকেন্দ্রেই তাদের অবাধ সুযোগ থাকবে। আমরা এর লক্ষ্যেই কাজ করছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, চিকিৎসকসহ সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে এ ব্যাপারে সচেতনতার কাজ চলছে। তবে কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চেম্বারে চিকিৎসাসেবা না পেলে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ওই স্বীকৃতি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। স্বাস্থ্যসেবাসহ মিলছে না তাদের মৌলিক অধিকারই। এমনকি ট্রাফিক পুলিশ পদে তাদের চাকরি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন