মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আদালতে প্রধান বিচারপতি : দু’মন্ত্রীর শপথ ভঙ্গ

প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪০ পিএম, ২০ মার্চ, ২০১৬

শেখ জামাল : মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়ে তা ভঙ্গ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। আদালত অবমাননা করায় এই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে সিনহা) সিনহা। তিনি দুই মন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তাতে প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি, বরং বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে পদদলিত করেছেন। আদালত সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। সংবিধানের ১৪৮ পড়েন। আপনারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। সেই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এর পরিণতি কি হবে। একজন মানুষ যতবড় ক্ষমতাধরই হোন না কেন আইন সোজা পথে চলে, আঁকাবাঁকা চলে না। অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যেকোনো আদেশ দিতে সংকোচ বোধ করব না।
আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী গতকাল রোববার সকালে আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে রুলের জবাব দাখিল করেন। অবশ্য তারা আগেই আইনজীবীর মাধ্যমে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মামলার আপিলের রায় নিয়ে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্যের বিষয়ে দুই মন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা যথাযথ না হওয়ায় গতকাল তাদের নতুন করে ব্যাখ্যা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে আগামী ২৭ মার্চ আবারও রুলের শুনানিতে হাজির হতে বলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ গতকাল এই আদেশ দেন।
সংবিধানের ১৪৮ বলা হয়েছে, ১৪৮। (১) তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যে কোন পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভার গ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল-অনুযায়ী শপথগ্রহণ বা ঘোষণা (এই অনুচ্ছেদে ‘শপথ’ বলিয়া অভিহিত) করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিবেন। ১০১[ * * *]
(২) এই সংবিধানের অধীন নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির নিকট শপথগ্রহণ আবশ্যক হইলে ১০২[ * * *] অনুরূপ ব্যক্তি যেরূপ ব্যক্তি ও স্থান নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ ব্যক্তির নিকট সেইরূপ স্থানে শপথগ্রহণ করা যাইবে।
১০৩[ ২(ক) ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এই সংবিধানের অধীন এতদুদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তদুদ্দেশ্যে অনুরূপ ব্যক্তি কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোন ব্যক্তি যে কোন কারণে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পাঠ পরিচালনা করিতে ব্যর্থ হইলে বা না করিলে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার উহার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে উক্ত শপথ পাঠ পরিচালনা করিবেন, যেন এই সংবিধানের অধীন তিনিই ইহার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি।]
(৩) এই সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
শপথ ভঙ্গের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন ইনকিলাবকে বলেন, আদালত সংবিধানের অভিভাবক। আদালত অবমাননা সংবিধান লঙ্ঘন করার শামিল। মন্ত্রীরা সংবিধানের শপথ গ্রহণ করেন। সেই মন্ত্রীরা শপথ ভঙ্গ করলে পদ থাকে না।
দুই মন্ত্রীর পক্ষে আদালতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার শুনানিতে অংশ নেন।
সকাল সোয়া ৯টায় আদালত অবমাননার শুনানি শুরু হলে দুই মন্ত্রী আদালতে পাঁচ মিনিটের দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় আ ক ম মোজাম্মেল হকের পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বসার অনুমতি চাইলে আদালত তাঁকে বসার অনুমতি দেন। অন্যদিকে কামরুল ইসলামের পক্ষে অ্যাডভোকেট বাসেত মজুমদার বসার অনুমতি চাইলে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনাদের তো কোনো জবাব পাইনি।’ জবাবে বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা জবাব দিয়েছিলাম।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জবাবে আপনারা কী বলেছেন, পড়েন।’ এ সময় বাসেত মজুদমার খাদ্যমন্ত্রীর জন্য আবারও বসার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেন আদালত।
বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা ভুল করেছি। নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকব বলে অঙ্গীকার করছি। আদালত এবং বিচারপতিদের প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান রয়েছে। আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এ জন্য আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ওই সময় আমি দেশের বাইরে, নেপালে ছিলাম। আমি হাইকমিশনারের ফোন থেকে আইনমন্ত্রীকে ফোন দিয়ে বলেছি, দুইজন মন্ত্রী যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়টি যেন কেবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয় এবং দুই মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করেই যেন নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চান। ক্ষমা না চাইলে পরিণতি খারাপ হবে। এরপর আমি বিমানবন্দর থেকে বাসায় না গিয়ে সরাসরি কোর্টে এসেছি। এ সময় আপিল বিভাগের সব বিচারপতি বিষয়টি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেছেন। আমি আইনমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, কেবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী তাদের বকাঝকা করেছেন। জবাবে আমি বলেছি, বকাঝকায় কাজ হবে না, নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। চুল পরিমাণও যেন বরখেলাপ না হয়। পরের দিন মীর কাসেম আলীর গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেব। রায়ের আগের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত বিচারপতিদের নিয়ে মিটিং করেছি আমরা। সেখানে আইনমন্ত্রী আসলেন। বিচারকদের সাথে কথা বললেন না।’
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘আদালত সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। আপনারা মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। আপনারা যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তাতে প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি, বরং বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে পদদলিত করেছেন। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিলেও অন্যদেরকে তো তিনি কিনতে পারবেন না। রায় তো প্রধান বিচারপতি একা দেন না।’
এ সময় দুই মন্ত্রীর আইনজীবীকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা কী জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার রায় পড়েছেন? সেখানে আমরা আদালত অবমাননার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি।’
কামরুল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কী কাসেম আলীর রায়কে প্রভাবিত করার জন্যই এ মন্তব্য করেছেন?’ এরপর বাসেত মজুমদারকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সঠিক হয়নি। পড়াশোনা করে আসবেন। ব্যাখ্যার পাঁচ নম্বর প্যারাতে সাংঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে। আপনি জানেন সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না।’
এ সময় আ ক ম মোজাম্মেল হকের আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘সংবিধান এবং আদালত মানতে সবাই বাধ্য।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কুৎসা রটনা, বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ এগুলো ফৌজদারি অপরাধ। ডাকাতি মামলার আসামিকে যে সাজা দেয়া হয় আদালত অবমাননাকারীকেও একইভাবে সাজা দেয়া হয়। মন্ত্রী হিসেবে আপনারা শপথ নিয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে টকশোতে যাবেন বিচার বিভাগ নিয়ে সমালোচনা করবেন। আপনি স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন কি হবে? টকশোতে যাবেন বাড়াবাড়ি করবেন। এটা আর দেখতে চাই না। সংবিধানের ১৪৮ পড়েন। আপনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। আপনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। শপথ নিয়ে সংবিধান ভঙ্গ করলে এর পরিণতি কী হবে তা ভেবে দেখেছেন? দেশ তো চলতে হবে। সংবিধান রক্ষা করতে হবে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সংবিধানের চুল পরিমাণও ব্যত্যয় ঘটাতে পারি না। একজন সাধারণ নাগরিক আর দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার বিষয়টি এক নয়।’
এ সময় রফিক-উল হককে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো আসামিকে অভিযোগ গঠনের পূর্বে আদালতের এজলাসে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় দোষী না নির্দোষ। তখন আসামি যদি দোষ স্বীকার করে তখন আদালত কী করেন? ’ জবাবে রফিক-উল হক বলেন, ‘তখন আদালত তাঁকে লঘুদ- দিতে পারেন। তবে এখানে আমরা অন্যায় করেছি, মাফ চেয়েছি। এখন পুরো বিষয়টিই আদালতের ওপর নির্ভর করছে।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রধান বিচারপতি যদি মীর কাসেম আলীর মামলা থেকে অবসরে চলে যেতেন, তাহলে দেশে দাঙ্গা লেগে যেত। যুদ্ধাপরাধের মামলা বানচাল হয়ে যেত। আমরা জানি দেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা এবং তারা কে কী অবদান রেখেছেন। এই আদালত থেকে অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সিদ্ধান্ত দিয়েছি।’
কামরুলের আইনজীবী বাসেত মজুমদার বলেন, ‘মাই লর্ড আপিল বিভাগ অনেক উদার। ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিতে হয়।’ আদালত বলেন, ‘ক্ষমা চাইলে দুই লাইনে চাওয়া যায়। কিন্তু আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা যথাযথভাবে পুনরায় ব্যাখ্যা জমা দেব। এ জন্য আদালতের কাছে সময় চাইছি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা যদি মক্কেলের সুরক্ষা দিতে না পারেন, তাহলে আদালতে আসবেন না। যতবড় ক্ষমতাধরই হোন না কেন আইন সোজা পথে চলে, আঁকাবাঁকা চলে না। অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যেকোনো আদেশ দিতে সংকোচ বোধ করব না।’ এরপরই আদালত শুনানি ২৭ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করে ওই দিন দুই মন্ত্রীকে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গত’গত ৫ মার্চ ঢাকায় এক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেমের আপিলের পুনঃশুনানির দাবি তোলেন কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আপিলের শুনানিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ‘রায়েরই ইঙ্গিত’ মিলছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও প্রধান বিচারপতির মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান বলে গণমাধ্যমের খবর। তাদের ওই বক্তব্য সে সময় তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।
৮ মার্চ মীর কাসেমের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আপিল বিভাগের সব বিচারককে নিয়ে বসে দুই মন্ত্রীকে তলবের আদেশ দেন। দুই মন্ত্রীর দেয়া যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে তা বিচার প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদাকে হেয় করার শামিল বিবেচনা করে কারণ দর্শাও নোটিস দেয়া হয় তাদের।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন