সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সহিংসতা শঙ্কায় ইউপি ভোট

তৃণমূলে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি : সংঘর্ষে ইতোমধ্যে নিহত ১২, গুলিবিদ্ধসহ আহত সহ¯্রাধিক

প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৯ পিএম, ২১ মার্চ, ২০১৬

আজিবুল হক পার্থ : তফসিলের পর থেকে অব্যাহত সহিংসতার মাধ্যমে আজ সকাল থেকে শুরু হচ্ছে গ্রামগঞ্জের ভোট। এ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে চলছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি, নির্বাচনী সংঘাত। সহিংসতায় এ পর্যন্ত মোট নিহত হয়েছে ১২ জন। গতকাল সোমবার বান্দরবানে এক প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মহেশখালিতে আ’লীগের সাথে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে। বিরোধী প্রার্থীদের এজেন্টদের তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুমকি, গ্রেফতার ও মারপিটের অভিযোগ এনে গতকালই কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাতেই কেন্দ্র দখল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন জেলা ও থানা অফিস এবং সচিবালয়ে হাজারো অভিযোগ জমা পড়লেও ইসি এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু সহিংসতার মধ্যেই সুষ্ঠু ভোটের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন ইসির কর্মকর্তারা। রোববার থেকেই ৬৬০টি ইউনিয়নে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এমনকি ক্ষমতাসীনদের জোটের শরীক দলও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। একই সাথে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। আর সাধারণ ভোটাররা শুরু থেকেই আছেন শঙ্কার মধ্যে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৭-০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ১৪ সালের পর থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোতেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইউপি নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে। সহিংসতার মূল কারণটিই হচ্ছে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচন করা। আগে সহিংসতা হতো নির্বাচনের পর, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগেই সহিংসতা শুরু হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে ৩৪টি জেলার ৭১৫টি ইউপিতে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোট গ্রহণ করা হবে ৬ হাজার ৯৮৭টি কেন্দ্রের ৩৫ হাজার ২৭১টি কক্ষে। নির্বাচনী এলাকায় মোট ভোটার ১ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৭৪১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫৯ লাখ ৯৫ হাজার ২৬৯ জন, মহিলা ভোটার ৫৯ লাখ ৪২ হাজার ৬৯৪ জন। তৃণমূল পর্যায়ের এ ভোটে এ পর্যন্ত ১২ জন নিহত ও সহ¯্রাধিক প্রার্থী-সমর্থক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এর আগে গত রোববার যশোরে একজন নিহত হন। এদিন ভোলায় মেম্বার প্রার্থী হাতের কব্জি কেটে নেয় প্রতিপক্ষ। এর আগে পরপর চার দিনে দেশের তিন জেলায় তিনজন নিহত হন। ১৪ মার্চ মেহেন্দীগঞ্জে একজন নিহত হয়েছে। এর আগের দিন বগুরারা শিবগঞ্জে নিহত হয়েছে একজন, ১৩ মার্চ কিশোরগঞ্জের বেরুয়াইল গ্রামে একজন, ১০ মার্চ ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নে একজন, ৯ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে একজন, ৮ মার্চ পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় একজন, ২২ ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীর হলদিয়া ইউনিয়নে একজন এবং সাতক্ষীরায় একজন নিহত হন।
প্রতিপক্ষের অব্যাহত হামলা-হুমকি ও প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগ এনে ভোলার সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদী বিএনপির দলীয় প্রার্থী রাইসুল আলম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে, সাতক্ষীরায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে প্রকাশ্যে নৌকা ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে না যেতে আহ্বান জানাচ্ছেন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনাস্থলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপস্থিত থাকছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এখানকার বিরোধী প্রার্থীদের অভিযোগ, ভোটের আগেই কেন্দ্র দখল হচ্ছে। তাহলে ভোট আর কী হবে?
ইসির গণসংযোগ পরিচালক এএসএম আসাদুজ্জামান দেওয়ার তথ্যমতে, প্রথম ধাপে ৭৩৪টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ১১টি ইউপিতে ২৩ মার্চ ও টেকনাফের হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউপির ভোট হবে ২৭ মার্চ। আর ভোলার ৬ ইউপির ভোট স্থগিত করা হয়েছে। রোববার রাতে সে মতে ২২ মার্চ ভোট হবে ৭১৫ ইউপিতে।
এসব ইউপিতে মোট ১৪টি দল প্রার্থী দিয়েছে। চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্রসহ মোট ৩ হাজার ৩৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটের মাঠে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদের আসনে ৭ হাজার ৫৭৫ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ২৫ হাজার ৮৪৭ জনের মধ্যে লড়াই হবে।
নির্বাচনে ভোট ছাড়াই ৫৪ চেয়ারম্যান ৫৪ জন নারী সদস্য এবং ১৭৯ জন সাধারণ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
গত রোববার রাত থেকেই নির্বাচনী এলাকার মাঠে নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রায় ২ লাখ ফোর্স মাঠে থাকবে। একই সঙ্গে সোমবার মধ্যরাত ১২টা থেকেই বন্ধ হয়েছে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা। ইউপি নির্বাচনে সাধারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রভেদে ১৭ থেকে ২০ জন সার্বক্ষণিক ফোর্স মোতায়েন থাকবে।
অন্যদিকে, প্রতি উপজেলায় ২টি করে র‌্যাবের মোবাইল টিম ও ১টি স্ট্রাইকিং টিম এবং প্রতি উপজেলায় ২ প্লাটুন বিজিবি মোবাইল ফোর্স ও ১ প্লাটুন স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি উপজেলার জন্য কোস্টগার্ডের ২ প্লাটুন মোবাইল ফোর্স ও এক প্লাটুন স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকছে। যারা ভোটের দু’দিন আগে থেকে পরে এক দিন মোট চার দিনের জন্য নিয়োজিত থাকবে।
গতকাল সকাল থেকে প্রত্যেক উপজেলায় নির্বাচনের ব্যালট পেপারসহ যাবতীয় মালামাল পৌঁছানো হয়েছে। মালামাল নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসাররা ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করবেন।
সরকারি হিসাবমতে, এ পর্যন্ত সারাদেশে ২১২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৯ জনের মৃত্যুসহ আহত হয়েছেন ৬৮০ জন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪৩টি, থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে ৫৫টি ও গ্রেফতার করা হয়েছে ৯৫ জনকে।
এদিকে প্রতিনিয়ত নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচার-প্রচারণা চালালেও ইসি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন প্রার্থীরা। আবার দু-এক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ইসি মামলা করতে কিংবা সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলেও মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ইসির এসব নির্দেশনা মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভোট কারচুপি হলে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা দায়ী হবেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ দায়িত্ব পালনে অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বরতদের দায়ী করা হবে। কেন্দ্রে রাতে নিবিড় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনো কেন্দ্রে ভোটের আগের দিন রাতে সিল মারার খবর পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও দায়িত্বরত কর্মকর্তা দায়ী হবেন।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকজন ওসি ও ইউএনওকে বদলি ও সতর্ক করা হয়েছে। তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ, সতর্ক থেকে এ ধরনের বে-আইনি কার্যক্রম প্রতিহত করবেন।
গ্রামেগঞ্জে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি
নির্বাচনকে পুঁজি করে সক্রিয় বিভিন্ন জেলার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভাড়াটে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের কদর এখন তুঙ্গে। পছন্দের প্রার্থীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতিও প্রদর্শন করছে তারা। কোনো কোনো প্রার্থী ঢাকা ও বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্রধারী ক্যাডারদের নির্বাচনী ময়দানে ভাড়া করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারাগার থেকেও অনেক দাগি সন্ত্রাসী তাদের ক্যাডারদের নির্দেশনা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিদেশে পলাতক অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীও টেলিফোনে সহযোগীদের নির্দেশনা দিচ্ছে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে। ক্যাডারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন নতুন অস্ত্র। গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে সম্প্রতি ধরা পড়া আগ্নেয়াস্ত্রের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের ৪৮টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের চালান প্রবেশ করছে। সবচেয়ে বেশি অস্ত্র এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভারতে তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ পিস্তল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনেছে চোরাকারবারিরা। সেই অস্ত্র বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। নাইন এম এম পিস্তল সীমান্তে বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। সেই অস্ত্র ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে অন্য জেলায় পৌঁছানোর পর। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে এই অস্ত্র বেশি ঢুকেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এগুলোর বেশিরভাগই এসেছে ইউপি নির্বাচনের ভোটের মাঠে ব্যবহারের জন্য।
দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক মাস আগে থেকেই সর্বত্রই অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্রও ভোটের মাঠে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় অবৈধ অস্ত্র-গুলির বেশ কয়েকটি চালান ঢুকে পড়েছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য এসেছে। ওইসব অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান চললেও উল্লেখযোগ্য কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ কারণে সাধারণ ভোটাররা শঙ্কিত। অনেকেই ভোট কেন্দ্রে যাবেন না ভয়ে-আতঙ্কে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন