মাত্র ৬০ কোটি টাকায় ওরিয়েন গ্রুপের কাছে কক্সবাজার সৈকতের দৃষ্টিনন্দন হোটেল শৈবালসহ ৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি গোপনে হস্তান্তরের বিষয়ে ফুঁসে উঠছে কক্সবাজার। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের রাজনীবিদ, সচেতন মহল, সিভিল সোসাইটি, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সাধারণ জনগণ। ইতোমধ্যে সরকারের এই বিশাল সম্পত্তি রক্ষায় ওরিয়েন গ্রুপের সাথে গোপনে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবী জানিয়েছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অবৈধ চুক্তির মাধ্যমে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি দখলে নিতে শৈবাল কর্মচারীদের সাথে মাস্তানী করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে ওরিয়েন কর্মীরা।
পর্যটন নগরী কক্সবাজার সৈকতের ঐতিহ্যবাহী হোটেল শৈবালটি গোপনে বেসরকারী খাতে চলে যাচ্ছে ওরিয়ন গ্রæপ নামে একটি প্রাইভেট কোম্পানীর কাছে। ৫০ বছরের জন্য মাত্র ৬০ কোটি টাকায় এটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। কঠোর গোপনীয়তার সাথে এ সংক্রান্ত টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় বলেও বিশ্বস্থ সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এতে পর্যটকসহ স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। পর্যটন কর্পোরেশনের এই পদক্ষেপ পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন পর্যটন বিশেষজ্ঞরা। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার সম্পত্তি সরকারের বেহাত হয়ে যাচ্ছে। এমন খবরে ফুঁসে উঠছে গোটা কক্সবাজারের মানুষ।
গত ৯ ডিসেম্বর এবিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি সংবাদ তোলপাড় সৃষ্টি করে সর্বত্র। ১০ ডিসেম্বর ইনকিলাবের সম্পাদকীয় কলামে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করে সরকারের বিশাল সম্পত্তি রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন খাতে বিরুপ প্রভাব বন্ধ করারও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়। জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে পর্যটন করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিতে পারে বিধায় অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে পর্যটন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ের প্ল্যানিং ডিভিশন পিপিপি অনৈতিকভাবে এর প্রস্তাবটি প্রস্তুত করে বলে জানা গেছে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনে ইনকিলাবের কপি ফাইল করা হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি সিরিয়াসলী নিয়েছেন বলেও জানাগেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন বলেও জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা জাসদের সভাপতি নাঈমুল হক চৌধুরী টুটুল জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে একটি ধান্ধাবাজ গ্রæপ সরকারের বিশাল সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার কাজটি করেছে। তিনি ওরিয়েন গ্রæপের সাথে নিয়ম বর্হিভূত সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশাল সরকারী সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পাশাপাশি তিনি এই ভ‚মিদস্যু গ্রæপকে প্রতিহত করার জন্য দল মত নির্বিশেষে কক্সবাজারের সর্বস্তরের মানুষকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান। তিনি আরো বলেন, শৈবালের সম্পত্তি রক্ষায় প্রয়োজনে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধসহ সব ধরণের কর্মসূচী দেয়া হবে।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামে সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক ফরহাদ ইকবাল বলেন, প্রাইভেট কোম্পানীর কাছে হোটেল শৈবাল হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে প্রচার হয়নি। এই চুক্তি বাতিল করার দাবি জানিয়ে তিনি প্রয়োজনে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলেও জানান।
শৈবালের জমি ওরিয়েন গ্রæপকে হস্তান্তরের জন্য পর্যটন করপোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ওরিয়েন গ্রæপকে পানির দামে মূল্যবান এই জমি দেয়ার যোগসাজেশ করেছে বলেও কথা উঠেছে।
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হোটেল শৈবালের বিভিন্ন পয়েন্টে ওরিয়েন গ্রæপের সাইনবোর্ড সাটানো হয়েছে। সাইনবোর্ড লাগাতে গেলে শৈবালে কর্মরত কর্মকর্তাদের সাথেও বাড়াবাড়ি হয় ওরিয়েন্ট কর্মীদের।
এ ব্যাপারে পর্যটন করপোরেশনের কর্মচারির ইউনিয়নের কক্সবাজার উপ-কমিটির সভাপতি মোঃ মহসিন জানান, ওরিয়ন গ্রæপের কাছে হোটেল শৈবাল হস্তান্তর করা হলে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তির সাথে শত শত শ্রমিকের চাকরিও চলে যাবে।
পর্যটন করপোরেশনের কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক সিজান বিকাশ বড়–য়া জানান, ওরিয়ন গ্রæপের কাছে শৈবাল হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তারা এখনো কোন চিঠি পায়ননি। তাই ওরিয়ন গ্রæপের কর্মচারিরা এখানে সাইনবোর্ড লাগাতে আসলে তাদের সাথে তর্কতর্কি হয়।
১৯৬৫ সালে সাগরিকা রেস্তোরা চালুর মধ্য দিয়ে কক্সবাজার পর্যটনে হোটেল শৈবালের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে এখানে আবাসিক প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। চড়ায়-উৎরাই পেরিয়ে পর্যটক ও স্থানীয়দের কাছে হোটেল শৈবাল বেশ সুনাম কুঁড়িয়েছে। ১৩৫ একর ভূমির উপর স্থপিত হোটেল শৈবাল সেই থেকে অর্ধ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে হোটেল শৈবাল পর্যটন শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। ১৩৫ একর মোট ভ‚মির ১৩০ একর জমি পিপিপি প্রকল্পের আওতায় হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে। একই সাথে ১৩০ একর জমি ছাড়াও হোটেল শৈবালের অত্যাধুনিক তিন তলা ভবন, সাগরিকা রেস্তোরা ভবন, সুইমিংপুল ভবন, লাইভ ফিস রেস্তোরার দোতলা ভবন, শৈবালের গলফ বার ভবনসহ মোট ১৪০ কোটি টাকার ভবনও হস্তান্তর করা হবে। পর্যটন এরিয়ার প্রাইম লোকেশনে হোটেল শৈবালের প্রতি শতক জমির মূল্য নূন্যতম ৩৫ লক্ষ টাকা ধরা হলে ১৩০ একর জমির মূল্য প্রায় ৪ হাজার ৫৫০ কোটি। এছাড়া হোটেল শৈবালের ভবনসহ আশপাশের অন্যান্য ভবনের মূল্য ১৪০ কোটি টাকা। কিন্তু পিপিপি প্রকল্পের আওতায় বির্তকিত ওরিয়ন গ্রæপকে মাত্র ৬০ কোটি টাকায় শৈবালের সমস্ত সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়টি কার স্বার্থে কেউ জানেনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন