পঞ্চায়েত হাবিব : বিদায়ী ২০১৭ সালটাই ছিল জনপ্রশাসনে চরম অস্থিরতা, বঞ্চনা ও আখের গোছানোর বছর। কিছু আমলার রাতারাতি উত্থান হয়েছে এ বছরেই। আবার এ বছরে অন্য বছরের চেয়ে বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। বেশি সংখ্যায় পদোন্নতি দেয়ার কারণে অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে। অনেক শীর্ষ পর্যায়ের আমলা ছিলেন আখের গোছাতে ব্যস্ত। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া. কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশে যাওয়া-আসা করে সময় কাটিয়েছেন তারা। অনেকে পরিবারের পুনর্বাসনেই বেশি সময় ব্যয় করেছেন। কেউ কেউ প্রশাসন ক্যাডারো অনেক কর্মকর্তা রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন বেশি। কেউবা সরকারের বিভিন্নপন্থউ হিসেবে ক্ষমতা দেখিয়েছেন। কেউবা সরকারের নিজস্ব লোক হলেও একেবারে চুপচাপ ছিলেন। বছরজুড়ে প্রশাসনে কয়েকজন সচিব ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং ডিজিরা তাদের ছেলের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির প্রসঙ্গ এসেছে। তাদের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া বদলি বা পদোন্নতি হয়নি- এমন কথা বলেছেন শীর্ষস্থানীয় আমলাসহ অনেকেই। ওদিকে বছরজুড়েই প্রশাসনে চরম স্থবিরতা বিরাজ করতে দেখা যায়। পদোন্নতির কারণে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ায় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জুনিয়ররা সিনিয়রকে না মানার প্রবণতা প্রকট আকারে দেখা দেয়। আমলাদের কাদা ছোড়াছুড়ি ও বিএনপিপন্থী আমলাদের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা সফল হয়নি। প্রশাসনে বর্তমান সরকারের আনুগত্য সচিবের সংখ্যা এখন অনেক। বিরোধী মনের সচিব নেই বললেই চলে। এ সরকারের আমলেই সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মকর্তা সচিব হয়েছেন আওয়ামী ঘরানার পরিচয় দিয়ে। সারা বছরই পদোন্নতি লেগে ছিল। সুযোগ-সুবিধারও কমতি ছিল না। প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারকে সর্বোচ্চ সুযোগ দেয়ার পরও মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের চিন্তা তাদের ঘিরেই। রংপুরে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল প্রশাসন। আওয়ামী লীগের অনেক মাঠের এমপি মনে করেন এই নিরপেক্ষতা অব্যাহত থাকলে সামনে অন্যান্য সিটি ও সংসদ নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে সরকারি দলের জন্য।
আমলাদের কাদা ছোড়াছুড়ি এ বছর সবচেয়ে বেশি ছিল জনপ্রশসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবদের মধ্যে। এছাড়া বছরের শেষ দিকে এসে বিএনপিপন্থী আমলারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য থাকার কারণে সফল করতে পারেননি। বিএনপি-জামায়াতপন্থী বলে পরিচিত আমলাদের একটি পক্ষ মাঠ গরম করার চেষ্টা করেছে। তারা পদোন্নতি ও পদায়নের দাবিতে দফায় দফায় প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের আমলাদের সঙ্গে দেখা করা মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চলে যাওয়া সময়ের সব ঘটনার স্থান হয় স্মৃতির খাতায়। ২০১৭ সালে দেশের প্রশাসনেও ছিল নানা ঘটনার ঘনঘটা। তবে জনপ্রশাসনে এ বছর নতুন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। স্থায়ী পদ না থাকার পরও দফায় দফায় পদোন্নতিতে এ বছর প্রশাসনের বিশৃঙ্খলা আরো বেড়েছে। যথারীতি চলতি বছরেও আলোর মুখ দেখেনি বহুল প্রতীক্ষিত সরকারি কর্মচারী আইনটি। একজন ইউএনওর এবং এডিসির বিরুদ্ধে মামলা করাসহ হয়রানির ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টির এই বছরই। ২০১৭ সালেই মারা যান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নতুন মুখ্য সচিব হিসেবে মো: নজিবুর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রশাসনে রেকর্ড পদোন্নতি : ২০১৭ সালে জনপ্রশাসনে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। গত বছর তিন দফায় অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপ-সচিবসহ বিভিন্ন পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব ও উপ-সচিব হিসেবে এমনিতেই নিয়মিত পদের চেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা রয়েছেন। তার ওপর আবার পদোন্নতিতে প্রশাসনে আরো বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। পদোন্নতি পাওয়ার পরও অনেকে নিচের পদে কাজ করছেন। গত কয়েক মাস ধরে জনপ্রশাসনে তিন স্তরে পদোন্নতির গুঞ্জন ছিল। সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর গভীর রাতে ১৯৩ উপ-সচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। এর আগে ১১ ডিসেম্বর প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পান ১৩৩ জন যুগ্ম সচিব। এখন প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা হলো ৫৬০ জন। যদিও অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা ১২১টি। অপরদিকে প্রায় ৪০০ যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদের বিপরীতে এখন যুগ্ম সচিব ৮৪২ জন। স্থায়ী পদ না থাকায় প্রশাসনে আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা নিচের পদে কাজ করছিলেন। এমন ব্যবস্থায় নতুন করে যুক্ত হলেন এ বছরের পদোন্নতিপ্রাপ্তরা। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা আরো বেড়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির পর সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও দুই শতাধিক কর্মকর্তার বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ ছিল। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে শতাধিক কর্মকর্তার বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগও ছিল। এর আগে গত ২৩ এপ্রিল প্রশাসনে সিনিয়র সহকারী সচিব ও সমমর্যাদার ২৬৭ কর্মকর্তাকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। এখন উপ-সচিবের সংখ্যা এক হাজার ৩৫৮ জন। উপ-সচিবের নিয়মিত পদ সাড়ে আটশ’র মতো। কিন্তু প্রশাসনের একেবারে নিচের দিকে কর্মকর্তা সঙ্কট রয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপ-সচিব পদেও পদোন্নতি শিগগিরই আসছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে। গত ১২ অক্টোবর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৮ প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে (পিও) নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
গত বছর সচিব হয়েছেন ২৭ জন কর্মকর্তা
প্রশাসনে বর্তমান সরকারের আনুগত্য সচিবের সংখ্যা এখন অনেক। প্রশাসনে ২০১৭ সালে শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া বছরজুড়ে ২৫ জন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি একজন, ৩ এপ্রিল একজন, ২৩ এপ্রিল একজন, ১০ জুলাই নয়জন, ২৪ জুলাই একজন, ১৩ আগস্ট পাঁচজন, ২৯ নভেম্বর চারজন এবং ৩১ ডিসেম্বর চারজন কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। বর্তমানে প্রশাসনে ৭৮ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব রয়েছেন।
ইউএনও তারেক সালমান ইস্যু : দুই ডিসি প্রত্যাহার
২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করে স্বাধীনতা দিবসের দাওয়াতপত্র ছাপানোর অভিযোগে বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারেক সালমানকে মামলাসহ হয়রানির ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করা আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। ইউএনওকে হয়রানির ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য গত ২৪ জুলাই বরিশালে জেলা প্রশাসক (ডিসি) গাজী মো: সাইফুজ্জামান ও বরগুনার ডিসি বশিরুল আলমকে ওএসডি করা হয়। শেষে চলতি বছরের ৩ আগস্ট গাজী সালমান তারিককে বদলি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব করা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুই বিভাগ
কাজের সুবিধার্থে দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিন্যস্ত করে দু’টি বিভাগ করার বিষয়টি আলোচিত হলেও চলতি বছরের ১৬ মার্চ তা বাস্তবায়ন হয়। পুনর্গঠিত দু’টি বিভাগের একটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, অপরটি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ।
আলোচিত আইন-নীতিমালা
২০১৭ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনেক আইন ও নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে কতগুলো আইন ও নীতিমালা ছিল নানা কারণে আলোচিত। বছরের ২৭ মার্চ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে মোটরযান চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি করতে বিশিষ্টজনদের দাবি থাকলেও তা অষ্টম শ্রেণি রেখেই সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৭-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। নানা ধরনের অনিয়মের জন্য এই আইনে শাস্তির মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। ৩১ জুলাই বিদ্যুৎ স্থাপনায় নাশকতার জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল বা ১০ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রেখে বিদ্যুৎ আইন, ২০১৭-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন। গত ২৭ জুলাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে নিকটাত্মীয়ের পরিধি বাড়িয়ে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৭-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন। অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে স¤প্রচার কমিশনের কাছ থেকে নিবন্ধন নেয়ার বিধান রেখে ১৯ জুন জাতীয় অনলাইন নীতিমালা, ২০১৭ অনুমোদন। মন্ত্রিসভা শাস্তি বাড়িয়ে আইন-শৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) (সংশোধন) আইন, ২০১৭-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় ৫ জুন। গত ১৫ মে সেনানিবাস (ক্যান্টনমেন্ট) এলাকায় মলমূত্র ত্যাগ, মাতলামি ও ভিক্ষাবৃত্তি করলে ২০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান রেখে সেনানিবাস আইন, ২০১৭ খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন। বেসরকারি ব্যাংকে একই পরিবারের দুইজনের পরিবর্তে চারজন সদস্যকে পরিচালক করার বিধান রেখে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০১৭-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন।
জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা-২০১৭ অনুমোদন, গত ২০ মার্চ নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন, ২০১৭-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব অনুমোদন। বেসামরিক বিমান চলাচল আইন, ২০১৭-এর খসড়া এবং যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৭-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন