চালুর সম্ভাবনা : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ফোরজি, এমএনপি ,ভয়েস মেইল সেবা
সুরাহা হয়নি : কলড্রপ, কম মূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, ডিজিটাল মিডিয়ায় বাংলা কনটেন্ট, নিরবচ্ছিন্ন ভয়েস সার্ভিস
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, ফোরজি, এমএনপি (মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি) সেবা চালু, কম মূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদানসহ গত বছর একগুচ্ছ স্বপ্ন দেখিয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপ তারিখও ঘোষণা করা হয়েছিল। এছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোন মূল্যে ফোরজি এবং এমএনপি সেবা চালুর কথা বলেছিলেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। এই সময়ে এমএনপির লাইসেন্স প্রদান ও দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে সংযুক্ত ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন অর্জনই হয়নি এই বিভাগে। আর দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হলেও তার সুফল এখনো পৌঁছেনি গ্রাহক পর্যায়ে। গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ কলড্রপ ও কচ্ছপগতির ইন্টারনেটের বিষয়ে সুরাহা হয়নি আজো। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তাই কমমূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদানকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন মোস্তফা জব্বার। একইসাথে ঝুলে থাকা অন্যান্য ইস্যু বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জকে ডুবন্ত নৌকার সাথে তুলনা করেছেন তিনি। গত শনিবার গোপালগঞ্জে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী একটি ডুবন্ত নৌকাকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার ওপর দিয়েছেন। আমি সফল হতে পারব এমন আস্থা ও বিশ্বাস থেকে প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর এ দায়িত্ব দিয়েছেন।
গত ১০ বছরে টেলিযোগাযোগ খাতের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। প্রায় শতভাগ এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসা, থ্রিজি চালু, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে সংযোগ, নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের অপেক্ষাসহ ১৪ কোটির বেশি মোবাইল সংযোগ ব্যবহারকারী হয়েছে। ২০০৮ সালে টেলিডেনসিটি ছিলো ৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ৮৮ শতাংশে। মোবাইল সাবস্ক্রাইবার ছিলো ৪৬ মিলিয়ন। এখন ১৪১ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ( ১৪ কোটির বেশি)। তবে এসব কিছুকেই সময়ের দাবি বলে মনে করেন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। বরং পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকা, ভারতের চেয়ে এখনো পিছিয়ে থাকাতেই বড় ব্যর্থতা মনে করেন তারা। সরকারের সবচেয়ে অগ্রগণ্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্ধারিত সময়ে উৎক্ষেপণ করতে না পারা, অন্যান্য দেশ ফাইভ জি চালু করলেও বাংলাদেশে এখনো ফোরজিতেই প্রবেশ করতে পারেনি। এছাড়া এমএনপি সুবিধা, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা, নিরবিচ্ছিন্ন ভয়েস কল সার্ভিস এখনো অসম্ভব হিসেবেই মনে করছেন গ্রাহকরা।
তাই সরকারের শেষ বছরে টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রত্যাশিত সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সেবার মান নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা দিয়েছে। আর এই চ্যালেঞ্জকে সফল করার জন্য ইতোমধ্যে এই খাতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতি মোস্তফা জব্বারকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি এই খাত সম্পর্কে বলেন, এই খাত অনেক সমস্যা ও জটিলতার মধ্যে আছে। এটিকে টেনে তুলতে হবে। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যেসব ইস্যু নিয়ে তিনি এতোদিন সরকারের সমালোচনা করেছিলেন এবং তা সমাধানের জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলেন তা এখন তাকেই করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কম খরচে ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ডকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া। তিনি গত কয়েকবছর ধরে এই ইস্যু নিয়ে সবচেয়ে বেশি মুখর ছিলেন। মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলো শহরভিত্তিক থ্রিজির নামে ভাওতাবাজি করছে, কম দামে ব্রডব্যান্ড স্পিড কিনে ডাটা হিসাবে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি করছে বলেও মন্তব্য করতেন তিনি। এছাড়াও সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেটের যে করুণ অবস্থা, প্রতিনিয়ত তিনিই তা তুলে ধরেছেন। ব্রডব্যান্ডকে (ডাটা নয়, স্পিড) মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করাও তার দাবি ছিল। দেশীয় সফটওয়্যার বাজারকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর রাহুমুক্ত করা ছিল বেসিস সভাপতি হিসেবে তার প্রধান দাবি।
তার মতে একদিকে ‹ডিজিটাল বাংলাদেশ› ভিশন বাস্তবায়নে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সফটওয়্যার বাজার তৈরী হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে কাজের অভাবে অনেক দেশীয় তরুণ উদ্যোক্তারা কোম্পানি বন্ধ করে দিচ্ছে, কেননা বাজার দখল করছে বিদেশী কোম্পানিগুলো! গত কয়েক বছর বেসিস এবং অন্য (বিসিএস, বাফকম) প্ল্যাটফর্ম-এর মাধ্যমে মোস্তাফা সরকারি বিভিন্ন ফোরামে এই বিষয়ে সরকারের জরুরি পদক্ষেপের ব্যাপারে নিরন্তন চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। আর ডিজিটাল মিডিয়ায় বাংলা কন্টেন্টের ব্যবহার বাড়ানো ছিল তার অন্যতম দাবি। তিনি মনে করতেন যে দেশের নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ ইংরেজি পড়তে পারে না, সেই দেশে এখনো বেশির ভাগ ডিজিটাল কনটেন্ট বা সার্ভিস ‹ইংরেজি› মাধ্যমে! দেশে সর্বস্তরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে মনে করেন মোস্তাফা জব্বার। এই সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন পর্যায়ে সকল ‹যোগাযোগ› ও ‹ইন্টারফেসিং› বাংলা মাধ্যমে করার ব্যাপারে সব সময়েই সোচ্চার ছিলেন তিনি। এখন সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে তাকেই। হাতে সময় মাত্র এক বছর। এর সাথে রয়েছে বিগত বছরে ঝুলে থাকা অসংখ্য প্রত্যাশিত সেবার প্রকল্প।
এর মধ্যে টেলিযোগাযোগ খাতে চারটি বড় প্রকল্প রয়েছে। দৃশ্যমান চতুর্থ প্রজন্ম (ফোর জি) নেটওয়ার্কের নিলাম, ভয়েস মেইল সার্ভিস চালু, মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) সেবা ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। দীর্ঘদিন ধরে এই চার বিষয় বাস্তবায়নের জন্য টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
ফেরজি সেবা চালু : ফোরজি সেবা চালুর জন্য গতবছর তোড়জোড় শুরু করেছিলেন তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তবে স্পেকট্রামের (তরঙ্গ) ফি নিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের আপত্তির মুখে তা নিষ্পত্তি হতে বছর শেষ হয়ে যায়। গতবছর শেষ দিকে ফোরজি নিলামের নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে সরকার। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) ফোর জি চালু করার জন্য জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে তরঙ্গ নিলামের প্রস্তুতি নিচ্ছে।এটি বাস্তবায়ন হলে গ্রাহকদের উন্নত টেলিকম সেবা, উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন গ্রাহকরা। এতে ভয়েসের চেয়ে ডেটার ব্যবহার বাড়বে। বর্তমান বিশ্বে ফোরজি টেলিযোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছিলেন, গ্রাহক সেবায় এই প্রযুক্তি আমাদের দেশে অবশ্যই চালু করা হচ্ছে। এই সেবা চালু নিয়ে মোবাইল অপারেটররা অনেক তালবাহানা করেছে। কিন্তু কোন তালবাহানা মানা হয়নি। আমরা জনগণের কাছে কথা দিয়েছি। তাদের এ সেবা পৌঁছে দিতেই হবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট: ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করার কথা ছিল। কিন্তু বেশ কিছু কারণে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের মার্চে স্যাটেলাইট মহাকাশে উড়বে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে কৃত্রিম উপগ্রহটির শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। ইতোমধ্যেই আইটিইউতে ইনোভেটিভ আইসিটি সলিউশন উপস্থাপন, প্রচার এবং সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট তৈরির কৃতিত্বে আইটিইউ টেলিকম ওয়ার্ল্ড এওয়ার্ড পেয়েছে স্যাটেলাইট প্রকল্প। গাজীপুরে স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশনের কাজ শতকরা ৯৮ ভাগ শেষ হয়েছে। আমেরিকাতে স্যাটেলাইট নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আবহাওয়া খারাপ বলে ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি। তবে মার্চে ভাল আবহাওয়ায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হবে।
এমএনপি সেবা: একই নম্বর অপরিবর্তিত রেখে অপারেটর বদলের সুযোগের জন্য এমএনপি সেবা চালু ছিল গ্রাহকদের দীর্ঘ দিনের দাবি। এই সেবা চালুর জন্য ইতোমধ্যে অপারেটরকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহকরা এর সুবিধা পাবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
ভয়েস মেইল সেবা চালু: বহুল প্রতিক্ষীত ভয়েস মেইল চলতি বছরের শুরুর দিকে চালু হচ্ছে। অনেকে মোবাইল কল ধরতে না পারলে ভয়েস মেইল পাঠাতে পারবেন। এজন্য ভয়েস মেইল পদ্ধতি আনা হচ্ছে। একজন গ্রাহক দিনে ২০টা পর্যন্ত ভয়েস মেইল পাঠাতে পারবেন। এতে খরচ ধরা হবে খুবই কম। ইতোমধ্যে মোবাইল অপারেটরদের চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের স্বল্প খরচে ভয়েস মেইল সার্ভিস চালুর কাজও শুরু করেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভয়েস মেইল চালু করা হবে বলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়।
এর বাইরে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমানো, আইএসপিদের দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা গ্রাহক পর্যায়ে পৌছানো, সহনীয় পর্যায়ে কলড্রপ নামিয়ে আনা, উন্নতমানের ভয়েস কল সেবা প্রদান করতে হবে গ্রাহকদের। কমিশন সূত্রে জানা যায়, ৫ এমবিপিএস দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদি কোন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোপাইডর (আইএসপি) গ্রাহক পর্যায়ে ৫ এমবিপিএস ডেটা না দেয় তাহলে তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আগে আইএসপিগুলো গ্রাহক পর্যায়ে এক এমবিপিএস মেগাবাইট পার সেকেন্ড দিত। কিন্তু দেখা গেছে, তারা এক এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ না দিয়ে সেটা ভাগ করে আরও কয়েকজন গ্রাহককে দেয়া হতো। এবার আইন করা হয়েছে গ্রাহকরা যাতে কোন অবস্থাতেই ৫ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের কম না পায়। এজন্য বিটিআরসিকে চিঠি দেয়া হয়েছে নিবিড়ভাবে মনিটর করতে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, প্রাইভেট অপারেটরগুলো আমাদের ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে ব্যবসা করছে। তারা পারলে আমরা পারব না কেন? আমার বিশ্বাস, কোথাও কোনো ভুল ছিল অথবা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। আমি এগুলো চিহ্নিত করব। তিনি আরো বলেন, ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার বিশ্বাস, ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত করতে পারলে আমরাও ব্যবসা করতে পারব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন