সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীতে চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরা, দক্ষিণগাঁও থেকে গাবতলী সর্বত্রই একই অবস্থা। সংস্কারের অভাবে পাথরকুচি, ইট সুরকি উঠে রাস্তাগুলো এখন যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। চলতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ছে যানবাহন। ঘটছে দুর্ঘটনা। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা, তিতাস গ্যাস ও টেলিফোন বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার দফায় দফায় খোঁড়াখুঁড়িতে রাজধানীর-বেশিরভাগ রাস্তাঘাটের এ দুরবস্থা। নগরবাসী জানে না কবে রেহাই মিলবে চরম এ জনদুর্ভোগ থেকে। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, নগরীর উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজ শেষ হতে আরও ৮/৯ মাস লাগবে।
গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা মডেল টাউনের বিভিন্ন রাস্তা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদাপাড়া, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ি, পুরান ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, শাহবাগ, এ্যালিফেন্ট রোড, হাতিরপুল, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট সরজমিনে পরিদর্শন করে এমনই চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সড়ক ও অলি-গলিতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়ও ভাঙাচুরা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। যে কারণে রাজধানীর প্রায় সবগুলো রাস্তাই এখন খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ৩০ মে’র মধ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয় থেকে থাকলেও এবছ তা সম্ভব হবে না। কারণ এবছর একসাথে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৩০০ সড়ক মেরামত ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন গুলশান-২ এর একটি সড়ক মেরামতের কাজসহ বড় বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। যা শেষ হতে ৮/৯ মাস সময় লেগে যেতে পারে। এদিকে অতিগুরুত্বপূর্ণ কোন কারণ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমোদন না দেয়ার জন্য ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ২৮দিনের মধ্যে উন্নয়ন কাজ শেষ করে পূনরায় রাস্তা মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও উন্নয়ন কাজ শেষে মাসের পর মাস রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা কর্মীরা এ সমস্ত উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি করে থাকেন। তাদের খেয়াল খুশি মতোই এ কাজগুলো শুরু ও শেষ হয়। সরকারী নিয়ম-নীতির দারধারেনা এরা। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেও তাকে আবার নাজেহাল হতে হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ নূরুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, উন্নয়ন কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যাতো হতেই পারে। এ জন্য নগরবাসীকেও কিছুটা ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। তিনি বলেন, আমি আর মেয়র মোহদয় মিলে রাত দিন চেষ্টা করে যাচ্ছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নগরবাসীকে এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেয়া যায়।
গত অর্থ বছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার সড়ক মেরামতের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এ বছর বরাদ্দ ৪৩১ কোটি টাকা। সেই সাথে দক্ষিণ সিটির জন্য ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপসড (ডিপিপি) এর আওতায় আরও ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া যাত্রাবাড়ি থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কের ১ কিলোমিটার, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সড়কের ১ কিলোমিটার ও ঢাকা ডেমরা সড়কের ১ কিলোমিটারের উন্নয়ন কাজের জন্য আরও ১৫০ কোটি টাকার সরকারি বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন খেলার মাঠ, পার্ক, শিশুপার্ক, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের জন্য আরও ১ হাজার ২৯২ কোটি টাকার সরকারি বিশেষ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা আগামী ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে খরচ করতে হবে।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের সড়ক উন্নয়ন ও মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ ও খরচ হয় কিন্তু সড়কের কোন উন্নয়ন হয় না। বছরজুড়েই চলে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি আর কাটাছেঁড়ার কাজ। বিশেষ করে অভিজাত এলাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরার সড়কগুলো বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। কোথাও চলছে স্যুয়ারেজ লাইনের প্রশস্ত পাইপ বসানোর কাজ। আবার কোথাও চলছে ওয়াসার পানি সরবরাহের লাইন মেরামত। টিএন্ডটি ও বিদ্যুৎ বিভাগের ভূগর্ভস্থ লাইন সংস্কার করতেও মাঝ বরাবর সড়ক কেটে চষা জমি বানিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকার বহু সড়কের এখন এই করুণ চিত্র। শেষই যেন হচ্ছে না খনন কাজ। দিন, সপ্তাহ পেরিয়ে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও এসব সড়ক চলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে না।
বিভিন্ন সংস্থার লাইন কিংবা স্যুয়ারেজের পাইপ বসানোর জটিলতাতেই শুধু সড়ক বন্ধ থাকছে তা নয়। সংলগ্ন ড্রেন পরিষ্কার করার ক্ষেত্রেও ব্যস্ততম সড়কের অর্ধেকটা পরিত্যক্ত করে ফেলা হয়েছে। গুলশান এভিনিউ, নিকেতনমুখী লিংক রোড, গুলশান ১ থেকে গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত এবং কূটনৈতিক এলাকা খ্যাত বারিধারার প্রধান সড়ক প্রগতি সরণির অর্ধেক ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা তুলে আটকে রাখা হয়েছে।
গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরের উত্তর পাশে ডিপিডিসি রোডের বেশির ভাগ এলাকা ময়লা-আবর্জনায় আটকে রাখা আছে। রাস্তাটির দক্ষিণ মুখে আছে ড্রেনের জন্য কাটাকাটি। দুই নম্বর গোলচত্বও পেরিয়ে বনানীর কাকলী মোড়ের দিকে এগোতেই কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর দুই পাশেই খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বর পেরিয়ে সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের পাশ থেকে কয়েকশ গজ সড়কে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ। বাঁশের আঁকাবাঁকা বেড়া, ড্রামের প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে বিপজ্জনকভাবে বাস-মিনিবাস যাতায়াত করে উল্টো রাস্তায়। সেখানে সড়কের বিরাট অংশ ঘেরাও দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির মাধ্যমে বড় ব্যাসার্ধের স্যুয়ারেজ লাইন বসানোর কাজ চলছে। এ নির্মাণ কাজের জন্য গুলশান ১ নম্বর থেকে মহাখালীগামী সড়ক এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ৯টি লিংক রোডে যাতায়াতকারী যাত্রীরা দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। আজাদ মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার মাঝামাঝিতে এবং ধানসিঁড়ি হোটেল গলির অর্ধেকটা জুড়ে খুঁড়ে রাখা হয়েছে দুই মাস আগে। ঠিকাদারের সঙ্গে জটিলতার কারণে সেখানে ওয়াসার কাজ স্থগিত থাকলেও রাস্তাটি খুলে দেওয়া হয়নি আর। ফলে চারটি রোডের বাসিন্দারা ঘুরপথে জ্যাম ঠেলে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
উত্তরা মডেল টাউন এলাকার রাস্তাগুলোর অবস্থা আরও বেহাল। এ এলাকার নাগরিকরা রাতদিন ভাঙাচুরা ও খানাখন্দকের রাস্তায় চরম ভোগান্তির মধ্যেই চলাচল করছে। একদিকে যেমন নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে সময় বেশি লাগছে আবার ভাড়াও গুনতে হচ্ছে অনেক বেশি। মাঝেমধ্যে রিকশা কিংবা অটোরিকশা উল্টে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। ৫, ৬ ও ১০ নং সেক্টরের রাস্তাগুলো অবস্থা এতটাই বেহাল যে ওই রাস্তা দিয়ে সুস্থ্য মানুষ চলাচল করতে গিয়েই অসুস্থ্য হওয়ার অবস্থা। ছোট ছেলে মেয়েদেরকে স্কুলে যেতে কিংবা অসুস্থ রুগিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পড়তে হয় কঠিন ভোগান্তিতে।
৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শাখা সড়কগুলো, ৬ নম্বর সেক্টরে আজমপুর বিজিবি কাঁচাবাজারের সামনের সড়ক, নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে রেল লাইন পর্যন্ত সড়কটি খানাখন্দে ভরা। ৭ নম্বর সেক্টরে পার্ক ও উত্তরা হাইস্কুলের সামনে-পেছনের সড়ক দুটির অবস্থা আরও নাজুক। এ ছাড়া ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের রাস্তায় রিকশায় যাতায়াতেরও যেন উপায় নেই। ঢাকার সঙ্গে পূর্বাচল নতুন শহরের সংযোগ স্থাপন, বিমানবন্দর সড়ক ও প্রগতি সরণি সংযোগস্থলে যানজট কমানো, নগরীর উত্তর-পশ্চিমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নির্মাণ হয়েছে কুড়িলের উড়ালসড়কটি। তবে উড়ালসড়কের ওঠানামার পথে বিপজ্জনক গর্ত, ভাঙাচোরা সুরকি বের হওয়া রাস্তায় গাড়ি চালাতে বেশ বিপাকে পড়েন চালকরা। বিমানবন্দর সড়ক থেকে এই উড়ালসড়কে ওঠার সময় খিলক্ষেতেই পড়তে হয় গর্তে। গাড়িচালকদের সন্তর্পণে এগোতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ গর্তের জন্য তৈরি হচ্ছে যানজট, কিন্তু তা মেরামতে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে শাখা রোড, অলিগলি, রাস্তাঘাটের অভিন্ন অবস্থা। প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। তবু মাসের পর মাস তা মেরামত হয় না। মেরুল বাড্ডার দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক এলাকার (ডিআইটি প্রজেক্ট) প্রায় সব সড়কের বেহাল দশা। ওই এলাকার ১৫টি সড়কের মধ্যে ১৪টিতেই রিকশা-সিএনজি অটোরিকশা চলাচলের উপায় নেই। সড়কগুলোতে বড় বড় গর্ত। কোনো কোনো গর্ত ডুবে আছে ড্রেন উপচানো পানিতে। এসব গর্ত লাফিয়ে ডিঙিয়ে পথ চলে কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ ওই এলাকার বাসিন্দারা। এলাকার ১০ নম্বর সড়কের মুখে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার। এ সড়কের অবস্থা এতটাই বেহাল অবস্থা যে, হেঁটে যাতায়াত করাই কষ্টকর। তবুও মানুষকে ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন