শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিএনপির সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিল পর্বতের মূষিক প্রসব

প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : গত ১৯ মার্চ শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মহা সমারোহে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। দেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মতো এত বৃহৎ পার্টির সম্মেলন ৮ শত মানুষের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আইইবির মতো ছোট কক্ষে অনুষ্ঠান করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। এই সরকার গণতন্ত্রের নামাবলি অঙ্গে ধারণ করে আছে, কিন্তু বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দলের জাতীয় সম্মেলন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো উন্মুক্ত স্থানে করার অনুমতি দেয় না। এই বিপুল সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও কয়েক হাজার কাউন্সিলর ইনস্টিটিউশনের বাইরে অবস্থান নিয়েছিলেন। যারা বাইরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের ¯্রােত মৎস্য ভবন পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। এসব কাউন্সিলর এবং ডেলিগেট যাতে সকলের বক্তব্য শুনতে পারেন, সেজন্য মৎস্য ভবন পর্যন্ত মাইক্রোফোন টাঙাতে হয়। যদি অনেক আগেই উন্মুক্ত স্থানে সম্মেলন করার অনুমতি দেওয়া হতো এবং যদি বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী আন্ডারগ্রাউন্ডে না থাকত, তাহলে এই সম্মেলনের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেত। তারপরেও বলা যায় যে, এই সম্মেলন কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য ও আশা-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, এই সম্মেলন সফল হয়েছে। তবে একটি সম্মেলন শুধু একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেই তার পূর্ণাঙ্গ সফলতা বিচার করা যায় না, সফলতার আরো কয়েকটি দিক থাকে।
যারা বলছেন যে, এখনও পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব নিয়োগ করা হয়নি, পূর্ণাঙ্গ স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি এবং উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা যায়নি Ñ এগুলি সম্মেলনের ব্যর্থতা, তারা সঠিক কথা বলেননি। সম্মেলনে ডেলিগেট এবং কাউন্সিলররা মহাসচিবসহ ওপরে উল্লিখিত সবগুলি কমিটি গঠন করার জন্য সর্বসম্মতভাবে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ক্ষমতা দিয়েছে। এই ক্ষমতা প্রদান সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক পন্থাতেই করা হয়েছে। এখন এসব কমিটি গঠনে বিলম্ব মানেই দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল রয়েছে, তেমনটি ভাবা সমীচীন নয়। ২১ জনের স্ট্যান্ডিং কমিটি, ৫ শতাধিক নেতার নির্বাহী কমিটি এবং শতাধিক নেতার উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা সহজ কাজ নয়। ধীরস্থীরভাবে ভেবেচিন্তে সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানকে এসব কমিটি গঠন করতে হবে। এজন্য দু-চার দিন কেন, এক মাস সময়ও যদি লেগে যায় তাহলেও কারো ভ্রæকুঞ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
কাউন্সিলের মূল্যায়ন : দিকনির্দেশনার অভাব
বিএনপি ক্ষমতা ছেড়েছে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। তারপর প্রায় ১০ বছর হলো, দলটি ক্ষমতার বাইরে আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটির শোচনীয় বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, দলটি অগোছালো হয়ে পড়েছিল। এখন ক্ষমতায় যেতে হলে অথবা সক্রিয় বিরোধী দল হিসাবে কাজ করতে হলে দলটিকে গুছিয়ে আনতে হবে। ১০ বছর ধরে দল গোছানোর কাজ চলছে। আজও সেই গোছানোর কাজটি সম্পন্ন হয়নি। কোনো দিন হবে বলেও মনে হয় না। কারণ এভাবে দলা গোছানো হয় না। দল গোছানোর অর্থ হলো দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে মজবুত করা এবং সংগঠনকে এগিয়ে নেওয়া। এজন্য প্রয়োজন দেশব্যাপী একঝাঁক কর্মিবাহিনী তৈরি করা। কিন্তু সেই কর্মিবাহিনী কোথা থেকে আসবে? কেন আসবে?
কর্মী আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো সুস্পষ্ট আদর্শ
সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা এমনি এমনি আসে না, তাদের রিক্রুট করতে হয়। এজন্য মহানগরী ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত একঝাঁক নেতা থাকে যারা তৃণমূল পর্যন্ত যোগাযোগ করেন। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের নেতা পর্যন্ত সকলেই সারা দেশে এবং নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক সফর করেন। সাংগঠনিক সপ্তাহ বা মাস পালন করার সময় নেতারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে বৈঠকে বসেন, মতবিনিময় করেন। এইসব বৈঠকের সময় তারা দলের তরফ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তিকা, গ্রন্থ, গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি প্রভৃতি বিতরণ করেন। দীর্ঘ ৬ বছর পর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন উপলক্ষে এসব কোনো কাজ করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। আর করা হয়ে থাকলেও সেটা হয়েছে দায়সারা গোছের। এসব বিষয়ের ওপর বিএনপির কোনো পুস্তিকা আছে বলেও শোনা যায়নি। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, ২০০৯ সাল থেকে দেশব্যাপী বিরোধী দলসমূহের ওপর যে নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চলছে, তার মধ্যে এসব কাজ করা অত্যন্ত কঠিন।
সাধারণ কর্মী থেকে যারা নেতা পর্যায়ে উঠে এসেছেন তারা জানেন যে, তারা প্রথমে একটি দলের প্রতি আকৃষ্ট হন তার আদর্শ এবং কর্মসূচি দেখে। এই ৬ বছরে বিএনপি তার নেতাকর্মীদেরকে কোনো আদর্শিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি। শুধু গণতন্ত্রের কথা অষ্টপ্রহর বললেই মানুষ আকৃষ্ট হবে না, তাদের একটি দর্শন দিতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি:
দি গ্রেট ডিভাইড
শুধু বাংলাদেশ আমল থেকে নয়, সেই পাকিস্তান আমল থেকে এমনকি ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের রাজনীতি একটি সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে ছিল হিন্দু-মুসলমান। পাকিস্তান আমলে ছিল বাঙালি এবং ইসলামী মূল্যবোধ। বাংলাদেশ আমলের প্রথম পর্বে আবার ইসলামী মূল্যবোধ এবং সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদের উত্থান। ২০০৯ সাল থেকে আবার ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান।
ভারত ফ্যাক্টর
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। উপমহাদেশের ছোট ছোট দেশ ভারতীয় প্রভুত্ব ও আধিপত্যবাদের শঙ্কায় অস্থির। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। অবাক ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ তীব্রভাবে বিভক্ত। সেকুলার এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এলে ভারতীয় আধিপত্য বেড়ে যায়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধপন্থীরা ক্ষমতায় এলে ওই প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে ভারতের ব্যাপারে বিএনপির ভ‚মিকা এবং অবস্থান দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এই কাউন্সিলে এসব প্রশ্ন অমীমাংসিত
বিএনপির গত কাউন্সিলে বেগম খালেদা জিয়া ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট ধরে ভিশন ২০-৩০ নামে যে বক্তৃতা করেছেন, সেটি কাউন্সিলের বক্তৃতা না হয়ে ইলেকশন মেনিফেস্টো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ইসলাম নামের কোনো শব্দ নেই। মুসলমান শব্দটি অনুপস্থিত। ভারত প্রসঙ্গ সযতেœ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার সেই সংলাপের কথা উচ্চারিত হয়েছে, যেটি আওয়ামী তোষণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার যে লুণ্ঠন হয়েছে সে সম্পর্কে বক্তব্যে বলিষ্ঠতা নেই। গুম, খুন এবং ক্রসফায়ার জোরালোভাবে হাইলাইটেড হয়নি।
বক্তৃতায় শুধুই গণতন্ত্র
গণতন্ত্র সর্বরোগের ধন্বন্তরী নয়। এটি পলিটিক্যাল সিস্টেমের একটি পার্ট হতে পারে। কিন্তু সেটি ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনবিধান নয় এবং কাউন্সিল সেই জীবনবিধান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট যে পার্লামেন্টের কথা বলা হয়েছে সেটি জনগণ বা কর্মীদের উদ্দীপ্ত করার মতো কোনো ইস্যু নয়। যিনি বা যারা এ ভাষণটি লিখেছেন তাদের সাথে মাটির এবং তৃণমূলের যোগাযোগ নেই। এটি গৎবাঁধা টেক্সট বুক রচনা। এখানে কর্মীদের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নেই আগামী দিনের আন্দোলন বা অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির কোনো ছক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন