তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস
আসুন আমরা আরো মানবিক হই। হাত বাড়িয়ে দেই শীতার্ত মানুষের প্রতি। গ্রাম-গঞ্জ ও চরাঞ্চলের যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-শিশু শৈত্যপ্রবাহের গরম কাপড়ের অভাবে জবুথবু হয়ে রয়েছে; তার প্রতি বাড়িয়ে দেই সহায়তার হাত। আপনার সামান্য সহায়তা, পুরনো কাপড়, যৌথ উদ্যোগের সহায়তা প্রচন্ড ঠান্ডাও ‘উষতায় হাসি’ ফোঁটাতে পারে শীতার্ত মানুষের মুখে। রাজনৈতিক দল, নেতা যারা ভোট এলেই ছুটে যান গ্রামে ভোট ভিক্ষার জন্য, গরীবের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য যারা বিদেশী টাকা এনে ফুলেফেঁপে উঠেছেন সেই এনজিও, যারা সাংস্কৃতির চর্চা করেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সমাজের উচ্চবৃত্ত, সমাজের পরোপকারী সবাই এগিয়ে এলে শৈত্য প্রবাহে কাবু দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী হতে পারে উপকৃত।
পৌষের শেষ সাপ্তাহে ব্যারোমিটার-থার্মোমিটার সব পরিমাপক যন্ত্রের পারদ নিম্নমুখী। তাপমাত্রা নামছে তো নামছেই। শৈত্যপ্রবাহে গোটা দেশ কাঁপছে; মানুষের যাপিত জীবন পর্যুদস্ত। শীতের প্রকোপে কাঁপছে হিমালয়ের পাদদেশ খ্যাত দেশের উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ গরীব মানুষ। কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় একই দৃশ্য। গরম কাপড়ের অভাবে নিম্নবৃত্ত, ছিন্নমূল এবং সীমিত আয়ের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে গেছে। খড়কূটোয় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা এখন রংপুর বিভাগের ৮ জেলার গ্রামীণ জনপদের দৃশ্য। আল্লাহর নেয়ামত গৃহপালিত পশুপাখিরও নিদারুণ দূরবস্থা। রাজশাহী বিভাগসহ দেশের অন্যান্য জেলার গ্রামগঞ্জ ও চরাঞ্চলের অভিন্ন দৃশ্য। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে গতকাল পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নেমেছে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য হলো স্বাধীনতার পর ৪৬ বছরে বাংলাদেশে তাপমাত্রা কখনোই এতো নীচে নামেনি। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল। অবশ্য ২০১৩ সালে ১১ জানুয়ারি সর্বনিন্ম তাপামাত্রা নিলফামারীর সৈয়দপুরে নেমেছিল ৩ ডিগ্রিতে।
‘উত্তরিয়া শীতে পরান কাঁপে থরথরি/ ছেঁড়া বসন দিয়া মায় অঙ্গ রাখে মুড়ি’ মৈমনসিংহ গীতিকার ‘মলুয়া’ গীতিকাব্য এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বর্তমান। চরাঞ্চল ও গ্রামের গরীব ছিন্নমূল মানুষ প্রচন্ড শীত থেকে বাঁচার জন্য গরম কপাড়ের প্রত্যাশায় মুখিয়ে রয়েছে। অথচ কেউ তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়চ্ছেন না। এদেশে শীতে গরীবের মাঝে গরম কাপড় বিতরণ, বন্যায় দুর্গতদের সহায়তা দান, ঘুর্নিঝড়-জলোচ্ছাসে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিভেদ-হানাহানি এবং সমাজের বৃত্তবান-সাংস্কৃতিসেবীদের সাধারণ মানুসের প্রতি অবহেলার কারণে সে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এই শীতে ছিন্নমূল মানুষের প্রতি সহায়তায় কম্বল-গরম কাপড় বিতরণ করতে দেখা যাচ্ছে না। টিভি পর্যায় যে শীতের ত্রাণ হিসেবে কম্বল বিতরণের দৃশ্য ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্যই। দেশের গ্রামাঞ্চলের যে ইউনিয়নে ৩ থেকে ৫ হাজার গরীব মানুষ গরম কাপড়ের অভাবে শৈত্য প্রবাহে ঠনঠন করে কাঁপছে; সেখানে দেয়া হচ্ছে একশ থেকে দেড়শ জনকে গরম কাপড়। পৌঁষের মাঝামাঝি থেকে শৈত্যপ্রবাহ চলছে অথচ সমাজের বৃত্তবানরা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের অতীতে আত্মমানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। তারাও এখন নীরব। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ক্লাব-পাঠাগারের তরুণ কিশোররা নিজ নিজ উদ্যোগে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে শীতার্তদের মাঝে বিতরণ করতেন। এখন সে দৃশ্য চোখে পড়ছে না। বৃহত্তর রংপুরের কয়েকটি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীতের হীমেল হাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। মহানবী (সা:) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন’ (আবু দাউদ শরিফ)। অথচ দেশের আলেম-ওলামারা নীরব। নীরব ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালে ভোটাররা উপকৃত হয়। শীতার্তদের সহায়তার সে দৃশ্য চোখে পড়ছে না। এ ছাড়াও দেশের সব সমাজকর্মী-এনজিও-বৃত্তবানের উচিত শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো; সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
সূর্যের আলোর ঝিলিক দুপুরে এক ঝলক দেখা গেলেও গতকাল হিমালয়ের কোলঘেঁষা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। নিলফামারীর সৈয়দপুরে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি, ডিমলায় ৩ ডিগ্রি, দিনাজপুরে ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৩ দশমিক ১ ডিগ্রি রংপুরে ৪ দশমিক ৯ ডিগ্রি, রাজশাহীতে রাজশাহীতে ৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি, বগুড়ায় ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি, নওগাঁর বদলগাছীতে ৪ ডিগ্রি, সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি, খুলনার মংলায় ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি, সাতক্ষীরায় ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি, যশোরে ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি, চুয়াডাঙ্গায় ৫ দশমিক ৪ ডিগ্রি, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি, খুলনায় ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি, ভোলায় ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি, খেপুপাড়ায় ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি, পটুয়াখালীতে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডায় এই জেঁকে বসেছে শীতে কাঁপছে বাংলাদেশ। শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। এতে করে তীব্র ঠান্ডাজনিত রোগে ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুধু কুড়িগ্রামে মারা গেছে ৬ জন। এরমধ্যে রাজারহাট উপজেলায় মারা গেছে ৩ জন। মৃতদের মধ্যে গত শুক্রবার সকালে নয়ন মনি ও বৃহস্পতিবার মীম সদর হাসপাতালে মারা যান। বাকি ৩ জনকে রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানায় কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ জাহাঙ্গির আলম। জানা যায় তীব্র ঠান্ডায় কাজে বের হতে পারছে না কর্মজীবী মানুষ। রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোর দৃশ্য এমন যে প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগেই তাপমাত্রা নিম্নগামী হওয়ায় সন্ধ্যার পরপরই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার ও দোকানপাট। ঘন কুয়াশায় যানবাহনও চলে হেড লাইট জ্বালিয়ে। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানু। গরম কাপড়ের অভাবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ। কাজে বের হতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ তথা ক্ষেতমজুর ও ক্ষুদ্র চাষী-বর্গাচাষীরা। রংপুরের পীরগাছা মহিলা কলেজের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম জানান, ঠান্ডায় গ্রামগঞ্জের মানুষ নিদারুণ কষ্টে রয়েছে। সরকারি পর্যায় বা বেসরকারি পর্যায়ে কোথাও শীত নিবারণের ত্রাণ হিসেবে কম্বল ও কোনো গরম কাপড় দেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
শুধু উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় নয় রাজধানী ঢাকায়ও একই দৃশ্য দেখা গেল। সোমবার সকাল ১১টা। স্পট সায়েদাবাদ বাসস্ট্রান্ড থেকে দক্ষিণদিকে দয়াগঞ্জ। রেল ব্রীজের পাশে দিকে রাস্তার আইল্যান্ডে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে দুই পথ শিশু। ক্ষণে ক্ষণে নড়েচড়ে উঠছে। পাশ দিয়েই শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছে বাস-সিএনজি। একটু পর পর চোখ খুলে ‘ওরে মাগো’ বলে আবার ময়লা কাঁথা মাথা পর্যন্ত টনে নিচ্ছিলো। একজন রিক্সাচালক এ দৃশ্য দেখে ডেকে বলে, ‘কিরে আইজ শীত কেমুন।’ পথশিশু দুটির একজন আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠে জবাব দেয়, ‘এমুন ঠান্ডা বাতাস শীত, মনে অয় কেউ সইলে (শরীরে) সুঁই ফুটাইতাছে।’ এরপর ওই রিক্সাচালক সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘ঠিকই কইছস, এমুন ঠান্ডা মনে অয় যেনো সাইবেরিয়ার শীত ঢাকায় নাইম্যা পড়ছে ঢাকাত।’ একই ধরণের দৃশ্য দেখা গেল রাজধানী সুপার মার্কেট আর বলধা গার্ডেনের মাঝদিয়ে যাওয়া ওভারব্রীজের নীচের দৃশ্য। কয়েকজন পথশিশু শীত থেকে বাঁচতে খড়কুঁটোয় আগুন জ্বলিয়েছে। পথচারীদের কেউ কেউ সেখানে গিয়ে হাতে তা দিচ্ছে। রাজধানীর কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, ধোলাইপাড়, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আজিমপুর, লালবাগ, স্বামীবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিল, মীরহাজির বাগ, ধনিয়া, রসুলপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন বয়সী নারী, পুরুষ ও শিশুরা সাধ্যমতো গায়ে গরম সোয়েটার, শাল, জ্যাকেট, মাফলার, কানটুপি ও হাতমোজা পড়ে রাস্তায় নেমেছেন। সবার এক কথা সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা এবার পড়েছে। ঢাকার রায়েরবাগে গার্মেন্টস কাজ করেন এক নারী শ্রমিক সোমবার সকাল ৮টায় পায়ে হেঁটে কাজলা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। শনির আখড়ায় বাসস্ট্যান্ডে তিনি বলেন, ভোর সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠার পর ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছিলো। কাজে যেতে মন চাইছিলো না। কিন্তু চাকরি বাঁচাতে এতো ঠান্ডার মধ্যেও কর্মস্থলে ছুটতে হচ্ছে। গ্রামে বৃদ্ধ বাবা-মা নিদারুণ কষ্টে রয়েছে। এমন শীত হলে তাদের মতো সাধারণ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।
সারাদেশের চিত্র প্রায় অভিন্ন। তবে চরাঞ্চলের শৈত্যপ্রবাহে মানুষের ভোগান্তি অবর্ণনীয়। মানুষের এই দুর্দশায় তাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। বৃত্তবান-সমর্থবানরা সবাই হাত বাড়িয়ে দিলেই এই হাড় কাঁপানো শৈত্যপ্রবাহে শীতার্ত মানুষগুলোর কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়। আসুন সাবই শীতার্তদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন