দেশে একসময় তুলা উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির জন্য গঠন হয় বোর্ড। কিন্তু এখন ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের’ মতো নামকাওয়াস্তে রয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কথা, দেশে তুলা আবাদ ও উৎপাদনের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ন্যুনতম উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ নেওয়া হলে তুলার চাহিদা বহুলাংশে মিটানো সম্ভব হবে। তা না হওয়ায় দিনে দিনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পুরোপুরি আমদানীনির্ভর হচ্ছে তুলা। আমদানীর ক্ষেত্রে কখনো কোন অসুবিধা সৃষ্টি হলে দেশের প্রায় ৪শ’ স্পিনিং মিল বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা থাকবে। সুত্রমতে, তুলা উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘদিন ধরেই চলছে খুঁড়িয়ে। কেন খুঁড়িয়ে চলছে, এর গলদটা কোথায়-তা কখনোই তদন্ত করা হয় না। বোর্ডটির মূল সমস্যা গবেষণা নেই। থাকলেও একেবারে দুর্বল। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে কৃষির এই খাতটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য নেই কোন পরিকল্পনা। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৯৯ভাগ তুলা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে আমদানী করতে হয়। সেক্ষেত্রে বিশাল বোর্ড ও বীজবর্ধন খামার রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু সেটি এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে।
গবেষণার দুর্বলতা এবং তুলা আবাদ ও উৎপাদনে নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মোঃ ফরিদ উদ্দীন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, খাদ্য উৎপাদনের দিকে বহুগুণে জোর দেওয়ার কারনে তুলা উৎপাদনের জন্য ফ্রি ল্যান্ড পাওয়া মুশকিল। তারপরেও আমি আশাবাদী দেশে ১০লাখ বেল উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিবছর দেশ প্রায় ৬৫ লাখ বেল তুলা আমদানী করছে। এতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২০হাজার কোটি টাকা। তার কথা, গবেষণার দুর্বলতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। তবুও চেষ্টা চলছে কিভাবে তুলা আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বোর্ডটিকে এগিয়ে নেওয়ার। সুত্রমতে, তুলা শুধুমাত্র বস্ত্রশিল্পের জন্যই নয়, অন্তত ৪শ’ রকমের পণ্য তৈরী হয়। বাংলাদেশেও তুলার বীচি থেকে সাবান ফ্যাক্টরীর ক্রুড অয়েল তৈরী হয়। আবার ক্রুড অয়েল রঞ্জন পদার্থ ‘গোসিপোল’ থাকে যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর বিধায় রিফাইন করে ভোজ্য তেল তৈরী করা হচ্ছে। তুলা বীচির খৈল ব্যবহৃত হয় চিংড়ি ঘেরেও। তুলার বীচি ভাঙ্গানো ও তেল-খৈল তৈরীর জন্য দেশে বেশ কিছু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ বহুমুখী সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে তুলা আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলে। সেজন্য দরকার সরকারী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্র জানায়, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের রয়েছে গবেষণাগার ও বোর্ডের হাজার হাজার একর বীজবর্ধন খামার। গবেষণারগুলোতে মূল্যবান যন্ত্রপাতি পড়ে থেকে মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে, ব্যবহার নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, বিটি কটন ও গবেষণা কার্যক্রমের ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে সাফল্য অর্জন করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরণ করেও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে কাড়ি কাড়ি টাকা করছে। অথচ তুলা আবাদ ও উৎপাদনে একসময় রেকর্ড সৃষ্টির বাংলাদেশ একেবারেই পিছিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে বোর্ডটি বিলুপ্ত করার পর্যায় সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এটি পরীক্ষিত যে, বাংলাদেশের মাটি তুলা আবাদ ও উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। একথাও ঠিক যে, বর্তমানে কৃষক বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে স্বল্পসময়ে তাৎক্ষণিক ফল লাভের আশায় তুলা আবাদে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। সুত্র জানায়, গবেষণাগারগুলোতে স্বল্পকালীন নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে না। দক্ষ ও বৈজ্ঞানিকের অভাবে যশোরের চৌগাছার জগদীশপুর, দিনাজপুরের সদরপুর, গাজীপুরের শ্রীপুর ও রংপুরের মাহিগঞ্জের গবেষণাগারের মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। গবেষণাগারগুলোতে যা বিজ্ঞানী দরকার কোথাও কোথাও শতবরা ৫ভাগও নেই। তুলা উন্নয়ন বোর্ড দাবি করেছে, তুলা আবাদে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড সুত্র অবশ্য স্বীকার করেছে, সারাদেশে তুলা আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যা ধরা হয়, নানা কারণে তা পুরণ হয় না নিকট অতীতের কোন মৌসুমেই। যার জন্য চীন, আমেরিকা ও ভারত থেকে তুলা আমদানীতে ব্যয় হয় হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ৪টি রিজিয়ন (আঞ্চলিক) রয়েছে। এটি আবার ভাগ করে ১৩টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছিল। যার আওতায় ছিল ১শ’ ৫৬টি তুলা উন্নয়ন ইউনিট। নিত্যনতুন বীজ উদ্ভাবন, তুলা চাষ স¤প্রসারণ, উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও গবেষণা কার্যক্রম চলছে নামকাওয়াস্তে। বিশাল বিশাল মাঠ বীজবর্ধন খামারের জন্য পড়ে আছে। আছে গবেষণাগার। কিন্তু নেই গবেষক ও বিশেষজ্ঞ।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, উপকুলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততায় মোটামুটি উঁচু জমিতে তুলা স¤প্রসারণ করা যেতে পারে। তুলা অনেকটা লবন সহিঞ্চু। কিন্তু উদ্যোগ ও দায়িত্ব এটি করবেন এরই অভাব রয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ডে। দেশের বৃহত্তম তুলা বীজ উৎপাদন ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে যশোরের চৌগাছার জগদীশপুরে। কেন্দ্রটি অনেকটা বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশাল এলাকার কেন্দ্রটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য লোকবল ও গবেষক দরকার। খামারটির জমিও যথাযথভাবে ব্যবহার হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন