আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে
ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ কৃষকরা ফসল কোন বছরই ঠিকমত ঘরে তুলতে পারেনা। প্রায় প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত তারা। এবারও সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধ নিয়ে চলছে গাফিলতি। বাঁধে ঠিকমত শতভাগ কাজ হয়নি। তা ছাড়া সময়মত সব হাওরে কাজ শেষ হয়নি। সংলিষ্ট ঠিকাদার, পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ও পাউবো কর্তৃপক্ষের গড়িমসির অভিযোগ তুলেছেন কৃষকরা। তাদের এ গড়িমসির কারণে বাঁধ নির্মাণ সময়মত হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন বাঁধে কাজের অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে। তাই বাঁধ নির্মাণ শতভাগ ও সময় মত হলে হয়তো কৃষকরা আশ্বস্ত হতে পারতো, অন্তত বাঁধের কারনে ফসল খোয়া যাবে না।
সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধ ফেব্রুয়ারী মাসের ভেতর শেষ করার কথা থাকলেও শেষ করতে পারেনি পাউবো (পানি উন্নয়ন বোড)। এবারও হাওর রক্ষা বাঁধ নিয়ে চলছে গাফিলতি। বাঁধে ঠিকমত শতভাগ কাজ হচ্ছে না। তাই কৃষকরা তাদের ফসল নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ এ এলাকার ফসল আগাম ঢলে ক্ষতি করে। প্রায় প্রতিবছরই এ রকম ঘটে। এ জন্যই কৃষকদের এত ভয়। স্থানীয় পানিউন্নয়ন বিভাগের সূত্র মতে এবার জেলার ৪০ টি হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধের কাজ করছে।এ জন্য বরাদ্দ হয় ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। জেলার দুই শতাধিক হাওরের মধ্যে ৪০ টি হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধের কাজ করছে। কাজ দেয়া হয়েছে ঠিকাদার ও পিআইসি (প্রজেক্ট বাস্তবায়ন কমিটি)কে। ঠিকাদাররা কাজ করছেন ৩০ কোটি টাকার। আর পিআইসির (প্রজেক্ট বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে কাজ হচ্ছে ১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার। সুনামগঞ্জের সব হাওরে এখন সুবজ ধান। ধান গাছে থোড় (ধানের ছড়া) ধরেছে। বৈশাখ মাসে কৃষকরা ধান কাটবে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন এবার কিছুটা বৃষ্টিপাত হওয়ায় বোরো ফসল ভাল হয়েছে। ধানের গাছ সতেজ হয়েছে। ফলন ভাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, এবার জেলায় বোরো আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৮০৫ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন। তবে সময়মত এবং হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণে শতভাগ কাজ না হওয়ায় ফসলের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত এ অঞ্চলের কৃষকরা। এ সময় বৃষ্টির খুব দরকার হলেও আকাশে মেঘ দেখলে কৃষকদের বুক কাঁপে। মনে ভয় থাকে, বেশী বৃষ্টিপাত হলে ফসল ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিনা। প্রায় প্রতি বছর পাহাড়ীঢলে বাঁধ ভেঙে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অকাল বন্যা ও পাহাড়ী ঢল থেকে ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছরই হাওর রক্ষা বাাঁধ নির্মাণ করা হয়। খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। এ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে প্রতিবছর অভিযোগও ওঠে। এবারও বাঁধের কাজ নিয়ে কৃষকদের নানান অভিযোগ রয়েছে। দুবল বাঁধ গড়া, সময়মত কাজ শেষ না হওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ। তাছাড়া কোন কোন বাঁধে মাটি তোলা হচ্ছে এক্সিভেটর মেশিন দিয়ে। তাও আবার বাঁধের গোড়া থেকেই। এতে পানির ধাক্কায় বাঁধ ধসে যাবার এবং বাঁধ ভাঙার আশংকা করছেন কৃষকরা। কৃষকরা বলেন, দেরী করে কাজ কাজ করলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, পি আই সি ও কর্মকর্তাদের সুবিধা বেশী। পানি এলে কাজের হিসাব বা দায় থাকে না।
সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক হাওরের বাঁধে ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু কৃষকরা বলছেন ভিন্নকথা। তারা বলছেন গড়ে প্রতিটি হাওরে ৬০ ভাগের বেশী কাজ হয়নি। শনির হাওর পাড়ের বাসিন্দা মশলঘাট গ্রামের বিশিষ্ট সমাজ সেবক মুহাম্মদ শওকত মিয়া বলেন, শনির হাওরে আমার কয়েক হাল জমি রয়েছে। শনির হাওরের ঝালখালি বাঁধে খুবই দুর্বল কাজ হচ্ছে। বাঁধের নিচ থেকেই এক্সিভেটর মেশিন দিয়ে মাটি তোলা হচ্ছে বাঁধে। বাঁধের গোড়ায় বড় খাল খনন করা হয়েছে। পানি এলে পানির ধাক্কায় কিংবা বৃষ্টিপাতে বাঁধ ধসে খালে যাবার আশংকা রয়েছে। তাছাড়া এ বাঁধসহ গোটা শনির হাওর রক্ষা বাঁধে ৪০ থেকে ৫০ ভাগের বেশী কাজ হয়নি। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে ফোনেও পাওয়া যায় না। তাকে কয়েকবার ফোন করেছি, ফোন ধরেননি। সংশ্লিষ্ট উপসহকারী প্রকৌশলী (এস ডি ই) দীপক রঞ্জন দাসকে এ বাঁধের কাজ নিয়ে অভিযোগ করেছি। তিনি বাঁধের কাজ সম্পন্ন করার আশ^াস দিলেও কোন আলামত দেখা যায়নি। মুহাম্মদ শওকত মিয়া আরো জানান, শনির হাওরের আফর বেড়িবাঁধেও সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে না। তাই গোটা শনির হাওরের ফসল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঝালখালী বাঁধে কাজের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস ইনকিলাবকে বলেন, ঝালখালী বাঁধ নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। তা আমরা দেখছি । তিনি আরো বলেন পিআইসি ও ঠিকাদাররা ভালভাবে কাজ করছেন। অনেক বাঁধে প্রায় ৮০-৯০ ভাগ কাজ হয়েছে। কিছু কাজ বাকী থাকলেও এর মধ্যেই শেষ হয়ে যাাবে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, এর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। কিছু কিছু স্থানে বাঁধে ড্রেসিংসহ কিছু কাজ হচ্ছে। তাও শেষ হয়ে যাবে। শনির হাওর ঝালখালি বাঁধে অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এ অভিযোগ আমি পেয়েছি। তা দেখা হচ্ছে। ধরমপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব খাঁন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা যাই বলুক না কেন, আমি গত কয়েকদিন সোনা মোড়ল হাওর, ধানকুনিয়া হাওর, ঘোড়াডোবা হাওরসহ কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখেছি। কোন বাঁধে ৬০ ভাগ, কোন বাঁধে এর চেয়ে বেশী কাজ হয়েছে। তবে গড়ে ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে বলা যায়। তিনি বলেন, কাজ কত ভাগ হলো, এই পরিমাপের চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তোলা। এতে বাঁধ অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। পানির ধাক্কা সামলাতে পারবে কিনা আশংকা রয়েছে। তিনি অরো বলেন এখনও কাজ করছে ঠিকাদার ও পিআইসিরা। করচার হাওর পাড়ের বাসিন্দা আলী হায়দর বলেন, করচার হাওরের বেরিবাঁধে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কাজ হয়েছে। এডভোকেট সাহাবউদ্দিন চৌধুরী জানান, আমারও জমি আছে করচার হাওরে। এ হাওরে বাঁধের কারণে প্রতি বছরই ফসল খোয়া যায়। কৃষকরা আশায় বুক বেঁধে আছে তাদের স্বপ্নের ফসল বৈশাখ মাসে ঘরে তুলবে। কিন্তু এবারও পানি উন্নœয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি রয়েছে বাঁধের কাজে।
অনেক হাওরে বাঁধের কাজ হয়েছে। তাও দায়সারা গোছের। এমন অভিযোগ করেছেন শনির হাওরের পাড়ের বাসিন্দা কৃষক আব্দুস সাত্তার। ধরমপাশা উপজেলার দৈনিক ইনকিলাবের সংবাদদাতা মোফাজ্জল হোসেন সুবজ বলেন, সোনামড়ল হাওরে আমারও ক্ষেত আছে। আমি এলাকার কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখেছি। হাওর রক্ষা বাঁধে গড়ে ৬০ ভাগের বেশীকাজ হয়নি। গেল ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সুনামগঞ্জ সফরে এসে হাওর রক্ষা বাঁধ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দাবি করেন হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ ৮০-৯০ ভাগ হয়েছে। তবে কোন কোন হাওরের বাঁধে ৫০ থেকে ৬০ ভাগের বেশী কাজ হয়নি। এমনটাই অভিযোগ কৃষকদের। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, কোন কোন হাওরের বাঁধে কাজ চলছে। আশা করা যায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। সকল উপজেলার ইউ এন ও বাঁধের খোঁজ খবর রাখছেন। সুনামগঞ্জ -৪ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ইনকিলাবকে বলেন, এবার সংশ্লিষ্টবিভাগসহ ঠিকাদার কিংবা পিআইসির গাফিলাতির কারণে হাওরের ফসল খোয়া গেলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন