ফারুক হোসাইন : ৮ ফেব্রæয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেছে আদালত। সেই রায়ের দিকেই চোখ বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের। খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে সরকার ও সংসদের বিরোধী দলের নেতাদের এমন বক্তব্যের পরও ভয় পাচ্ছেন না তারা। বরং রায় নিয়ে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আইনি ও রাজনৈতিক দুটিকেই বিবেচনায় রাখছেন শীর্ষ নেতারা। রায় ঘোষণার পর পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিএনপির মধ্যে। কাগজপত্র, সাক্ষী, তথ্য-প্রমাণ বিবেচনায় এ মামলায় বেকসুর খালাস পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সিনিয়র নেতারা। রায় নিয়ে ভয় পাচ্ছেননা চেয়ারপারসন নিজেও। জেল-জুলুম সব কিছু উপেক্ষা করে মানুষের গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো অনঢ় তিনি। নেতাকর্মীরাও মনে করেন সরকার এখন একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নেতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত নিলে তাদের পতনের ভীত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি হয়ে যাবে। তবে আশা প্রকাশ করেই বসে থাকতে চান না নেতাকর্মীরা। সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে জেলে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ করে সিনিয়র নেতারা শুধু আইন লড়াই নয়, যে কোন পরিস্থিতির জন্য দলের নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়ার চেষ্টা করা হলে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতিও সেরে রেখেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এদিকে খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলের করণীয় নিয়ে আজ রাতেই জরুরী বৈঠকে বসছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির সভা। সেখানে খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা, রায় পরবর্তী দলের করণীয় ও কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় গুলশানের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ম্যাডাম। দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে বছরখানেক হাতে থাকতে ওই রায় সামনে রেখে আজকের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা।
মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, মামলার রায় নিয়ে দলে দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। যদি বিএনপি প্রধানকে সাজা দেয়া হয় তাহলে রায়-পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে এবং রাজনৈতিকভাবেও এটি মোকাবেলা করা হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার ডিটারমিনড যে, তারা আগামী নির্বাচন করতে চান বিএনপিকে বাদ দিয়ে এবং সেজন্যই তাড়াহুড়া করে বিচার কাজ শেষ করা এবং এ সমস্ত কমেন্ট করা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, অনেকদিন আগে থেকেই সরকারের লোকজন এই মামলা নিয়ে আগাম বক্তব্য দেয়া শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বহু আগেই রায় দিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় মনে আছে অনেক আগেই তিনি বলে দিয়েছিলেন এতিমের টাকার ব্যাপারে। অন্যান্য মন্ত্রীরা বলছেন। তারা প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি ক্ষণ তারা হুমকি দিয়েছেন, তারা শক্তি প্রয়োগ করেছেন, বলপ্রয়োগ করেছেন। কয়েকদিন আগে এরশাদ সাহেব রংপুরে বলেছেন, আর মাত্র কয়েকদিন তারপর যেতে হবে জেলে। তার দলের একজন প্রতিমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন। এধরণের কথা দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়, আগামী বলে দেয়া। রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের এই ধরণে কথা দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, তারা পূর্ব নির্ধারিত, পরিকল্পিত। দ্য আর প্রিপিয়ার্ড ফর এভরি থিং।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় আগামী ৮ ফেব্রæয়ারি। রাজধানীর বকশীবাজার ঢাকা আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় একটি মামলা করে দুদক। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
রায়ের তারিখ ঘোষণার পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম সদস্য আব্দুর রেজাক খান বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। কোনো এভিডেন্সেই মামলাটি প্রমাণিত হয়নি। কুয়েত থেকে আসা অর্থে খালেদা জিয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণ হয়নি। তাই তিনি এ মামলার সব আসামিকেই সসম্মানে বেকসুর খালাস দেয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনও একই ধরণের কথা বলে বলেন, ম্যাডাম নির্দোষ। তিনি খালাস পাবেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা হতে পারে এমন আভাস থেকেই গত কয়েক দিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন। সব বৈঠকে আলোচনা হয়েছে রায়-পরবর্তী করণীয় নিয়ে। জানা গেছে, যদি বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা হয়, সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ আদালতে জামিন চেয়ে আবেদন করা হবে। বেগম জিয়া গত বৃহস্পতিবার আদালতে রায়ের তারিখ ঘোষণার পরপরই বের হয়ে আইনজীবীদের উচ্চআদালতে আপিলের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেন। দ্রæত সময়ের মধ্যে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে, যাতে নি¤œ আদালতে সাজা হলেও আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আইনগত কোনো বাধা না থাকে। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও সংগঠনের সবপর্যায়ের নেতাকর্মীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সাজা হলে রাজপথে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে বলে দলটির শীর্ষ এক নেতা জানান।
মিথ্যা, বানোয়াট ও পাতানো একটি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হলে সেটাকে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবে বলে মন্তব্য করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কুয়েতের আমীর, জিয়াউর রহমানের নামে ট্রাস্টটিতে সরাসরি টাকা পাঠিয়েছিলেন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে দান করেছিলেন। সরকারের কোনো রিলিফ ফান্ডে আসেনি। তাই এর সাথে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারপরেও গায়ের জোরে তার বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে গেছে। বিএনপির এই নেতা বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। নির্বাচনের বাইরে রেখে তারা (আওয়ামী লীগ) আবার সেই ষড়যন্ত্র করছে। আমরা অতীতেও বলেছি, আজকেও বলছি, ২০১৪ সালের সেই নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে আর হবে না। বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে না। হতে দেওয়া হবে না।› খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার যতই ষড়যন্ত্র করেন না কেনো, আমরা সকল মামলা আইনিভাবে মোকাবেলা করেছি। যদি এই মিথ্যা, বানোয়াট, পাতানো একটি মামলাকে কেন্দ্র করে, আমাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে সেটাকে আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবো। রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য যে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হোক না কেনো সে ডাকে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়া দেওয়ার আহŸান জানান তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলায় নেতিবাচক কোনো রায় হলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কিছু হলে সারাদেশে আগুন জ্বালবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ’৭৫ সালে যেভাবে গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল, ঠিক সেইভাবে একই কায়দায় তার কন্যা দেশ পরিচালনা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি ছাড়াও ২০ দলীয় জোটের শরিকেরা রায়ে বিএনপি প্রধানকে অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হলে রাজপথে নামার কথা ভাবছে। ক্ষমতাসীন মহাজোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও খালেদা জিয়ার মামলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এ দিকে কূটনৈতিক পর্যায়েও মামলার গতিবিধি সম্পর্কে আপডেট রাখা হচ্ছে। মামলা নিয়ে দলের সংশয়ের কথা জানানো হচ্ছে তাদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন