শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে মুহাম্মদ সা. এর অবদান

মুহাম্মদ আতিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বর্তমান সময়কে বলা হয় সভ্য ও আধুনিক যুগ। কিন্তু একটি শ্রেণী এই সভ্যতার অন্তরালে আধুনিকতাকে পুঁজি করে বিশ্বকে অশান্ত করে তুলছে। যার কারণে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির মাঝে সংঘাত-হানাহানি, গৃহহারাদের হাহাকার এবং নির্যাতিত অসহায়দের আত্ম চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠছে। এ সভ্য ও আধুনিক বিশ্বের আচরণ যেন সাড়ে চোদ্দশত বৎসর আগের ‘বর্বরতার’ যুগকেও হার মানায়। আর ঐ অজ্ঞ ও বর্বর জাতিকে রাহমাতুল লিল আলামীন মুহাম্মদ সা. আল-কুরআনের বিধানের মাধ্যমে সু-সভ্য জাতিতে পরিণত করেছিলেন। কেননা ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। এ বিধানে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন পরিচালনার জন্য সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আর রাসূল সা. তার নব্যুায়াতি জীবনে এ সকল বিধানের বাস্তব গ্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। রাসূল সা. হিজরতের পর ‘মদিনা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সে রাষ্ট্রের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন গোত্রের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হন। আর আল্লাহ তাআলা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘চুক্তি’ বাস্তবায়নকে আবশ্যক করে ইরশাদ করেনে “তোমরা পারস্পরিক ওয়াদা পূরণ করো। কেননা এ ওয়াদা সম্পর্কে তোমরা অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।” আর মুহাম্মদ সা.ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন গোত্র ও রাষ্ট্রের সাথে কৃত চুক্তি বাস্তবায়ন করেন। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হুদায়বিয়ার সন্ধি। এ সন্ধির অন্যতম একটি ধারা ছিল “যদি কোন মক্কাবাসী ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় আশ্রয় নেয় তাহলে মদিনাবাসীগণ তাকে আশ্রয় দিবে না, পক্ষান্তরে মদিনার কোন মুসলিম যদি মক্কায় চলে আসে তাহলে মক্কাবাসীগণ তাকে মদিনায় ফেরত দিবে না।” যদিও চুক্তির এ ধারাটি মুসলামানদের জন্য অপমানজনক ছিল, তার পরও মুহাম্মদ সা. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তা বাস্তবায়ন করেন। যখন এ সন্ধি লেখা হচ্ছিল, তখন আবু জান্দাল নামে একজন মুসলিম শেকল পরিহিত অবস্থায় আল্লাহর রাসূল সা. এর নিকট এসে তাকে মুসলমানদের সাথে অন্তর্ভূক্ত করতে বলেন। কিন্তু তার পিতা সোহায়েল তাকে মুসলমানদের সাথে দিতে অস্বীকার করে রাসূল সা. কে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বলেন। কিন্তু চুক্তি লেখা শেষ না হওয়ায় রাসূল সা. আবূ জান্দালকে মুসলমানদের সাথে অন্তর্ভূক্ত করতে চাইলেন। তখন সোহাইল তার পুত্রকে ফিরিয়ে না দিলে চুক্তি থেকে সরে আসবেন বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। মক্কার সাথে সর্ম্পক উন্নয়নের খাতিরে রাসূল সা. আবু জান্দালকে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দেন এবং ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। রাসূল সা. মদিনায় প্রত্যাবর্তনের পর মক্কার কাফির মুশরিকের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবূ বাছির নামে এক মুসলিম পালিয়ে আসে। কিন্তু রাসূল সা. চুক্তি অনুযায়ী আবু বাছিরকেও মক্কার প্রতিনিধির কাছে ফিরিয়ে দেন। এভাবে তিনি মক্কার সাথে সর্ম্পক উন্নয়নের খাতিরে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত বাস্তবায়ন করে মক্কা থেকে আগত আশ্রয় প্রার্থী মুসলমানদের ফেরৎ দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখেন। রাসূল সা. বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট বিশেষ দূত মারফত চিঠি প্রেরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মচন করেন। সে সকল রাজা-বাদশাহদের মাঝে অন্যতম বায়যান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস, পারস্যের অধিপতি খসরু পারভেজ কিস্রা সাহ, আবিসিনিয়ার অধিপতি নাজাশী, কিবতী অধিপতি মুকাওকিস, বাহরাইনের শাসনকর্তা মুনযির ইবন সাবী, ইয়ামামার শাসনকর্তা হাওজা ইবনে আলী, দামেশেকের শাসনকর্তা হারেছ ইবনে আবু শিমার গাসসানি ও আম্মানের বাদশাহ যেফার। রাসূল সা. এসব চিঠির মাধ্যমে তাদের পালনকৃত ধর্মের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য বিষয়গুলো উল্লেখ করেন এবং আল-কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের কাহিনী বর্ণনা করে তাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বিশ্বশান্তি স্থাপনের আহবান জানান। রাসূল সা. এর চিঠি পেয়ে হাবশার বাদশা নাজ্জাশী ও আম্মানের বাদশা যেফার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং অধিকাংশ বাদশাহই তাঁর জন্য উপঢৌকন পাঠিয়ে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। মূলত রাসূল সা. এসকল চিঠি প্রদানের মাধ্যমে নব গঠিত মদিনা রাষ্ট্রেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেন এবং বিশ্বের পরাশক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা চালান। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম কৌশল বিজয়ী রাষ্ট্রের নাগরিকের উপর অত্যাচার-নির্যাতন পরিহার করা। কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো দেশ যখন অন্য কোনো দেশ জয় করে তখন বিজয়ী দেশ বিজিত দেশে ধ্বংস, হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতনসহ যে কোনো ধরনের অন্যায় অত্যাচার চালাতে দ্বিধা করে না। আর নবী সা. যখন কোনো এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন অত্যন্ত তাকীদ দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশনা দিতেন। আর সে সকল বিষয়গুলো হলো বিজিত এলাকায় বিশ্বাসঘাতকতা না করা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা, শত্রুদের হাত পা না কাটা, শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদের হত্যা না করা, ফলের বৃক্ষ না কাটা, খাবার প্রয়োজন ছাড়া বকরী, গাভী ও উট হত্যা না করা। এ জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের বাহিনী যখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো জনপদে প্রদার্পণ করেছে, তখন ঐ জনপদের অধিবাসীরা হাসিমুখে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। যার ফলে তাদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মুহাম্মদ সা. ত্যাগ ও ক্ষমার মাধ্যমে মদিনা রাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। মক্কা বিজয়ের পর সেখানকার অধিবাসী ধারণা করেছিল যে, তারা মুহাম্মদ সা. এর উপর যে অত্যাচার ও নির্যাতন করেছিল তিনি তার প্রতিশোধ নিবেন। কিন্তু তিনি মক্কার অধিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মদিনার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। মহানবী সা. এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য ছিল বিশ্ব ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। এ ভ্রাতৃত্বই সারা বিশ্বের মানুষকে এক সুতায় গ্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ভাষা, বর্ণ, পেশাগত ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তা মানুষকে শান্তি দিতে র্ব্যথ। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি আল-কুরআনের বাণী স্মরণ করিয়ে দেন, যেখানে বলা হয়েছে : “হে মানব জাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছি। যেন তোমরা পৃথকভাবে পরিচিত লাভ করতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় যে অধিক তাকওয়াবান।” সুতরাং অনারবের উপর আরবের, কালোর উপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই। তিনি আরও বলেন: ‘সমগ্র মানবজাতি এক আদমের সন্তান, আদমের প্রকৃত পরিচয় তাঁেক মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন থেকে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সকল দাবি, রক্ত ও ধন-সম্পদের সকল দাবি এবং সকল প্রতিশোধ, স্পৃহা আমার পায়ের নিচে পদদলিত হলো।’ এ হলো মুহাম্মদ সা.এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন নীতি। যার মাধ্যমে তিনি বর্বরতার যুগেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার বিধান করেছিলেন। আর তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য মুহাম্মদ সা. এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন