২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩২ ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড়
দেশে মিডিয়ার বিপ্লব ঘটলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অগ্রসর তেমন হয়নি। গণতান্ত্রিক দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অপরিহার্য। সীমিত পর্যায়ে হলেও তরুণ সংবাদকর্মীদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণেই হলমার্ক কেলেঙ্কারী, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারী, মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে সচিবদের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি, ডেসটিনি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ব্রীজ নির্মাণে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার, ইউনি পে টু কেলেঙ্করী, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শ কোটি টাকা ডিজিটাল চুরিসহ অনেকগুলো অঘটনের মুখোশ হয়েছে উন্মোচিত। সেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে নিরুস্বাহিত করতে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এ অনেকগুলো ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আইনের ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩২ ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সর্বত্রই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রিন্ট-টিভি মিডিয়া, রাজপথ এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিক-আইনজীবী-মানবাধিকার কর্মীরা ধারাগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। পত্রিকায় পাতা খুললে এবং টিভি পর্দায় তাকালেই প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের উল্লেখিত ধারাগুলোর বাতিলের দাবীতে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যায়। প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের ভয়ঙ্কর ধারাগুলো তুলে ধরে এক সেমিনারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, এ ধরণের আইনের মাধ্যমে দেশটাকে বার্মিজ গণতন্ত্র মডেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হলে নিঃসন্দেহে আমরা কাউয়া গণতন্ত্র হয়ে যাব।
আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়া হলেও আতঙ্ক-উৎকন্ঠ এখনো কাটেনি। ওই ধারায় দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের ঘোষণা আসেনি। দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী, সংবাদকর্মীদের চাপের মুখে বিতর্কিত ওই ধারাটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু নতুন করে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর কয়েকটি ধারা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিশেষ করে ৩২ ধারা নিয়ে সারাদেশের মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে তীব্র গণঅসস্তোষ বিরাজ করছে। জাতীয় সংসদে এখনো আইনটি উত্থাপনই হয়নি; অথচ মিডিয়াকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীরা এটাকে ‘কালো আইন’ বলছেন। ৫৭ ধারার অপব্যবহারের পর সাংবাদিক সমাজও এ আইন নিয়ে বেশ চিন্তিত। এ আইন চালু হলে দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে; প্রশাসনে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে; এবং দেশে মিয়ানমারের ন্যায় ‘কাউয়া গণতন্ত্র’ গণতন্ত্র চালু হবে এমন মতামত আসছে। দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী, রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ ও সাংবাদিক সমাজ এধরণের আইন কার্যকর না করার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। নানাভাবে তারা প্রস্তাবিত আইনের প্রতিবাদ করছেন। শুধু দেশেই নয়; আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) গত ২৯ জানুয়ারী মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ কে সংশোধন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংগঠনটির মতে প্রস্তাবিত আইনটি স্বাধীন মত ও তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি। সংবাদকর্মীদের ওপর জুলুম বাড়বে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে আইনটি প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে প্রতিদিনই। ঢাকায় সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ করছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। টিভির টকশোগুলোতে এ আইনের প্রতিবাদ করা হচ্ছে এবং আইন কার্যকর হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কি ভাবে হুমকির মুখে পড়বে সে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তোভোগীরা বলছেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ জাতীয় সংসদে পাস হলে দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে যাবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিতার জন্য গণমাধ্যমকর্মীরা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় যে ভাবে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন হয়েছে নতুন আইনে সেটা আরো ভয়াবহ হবে। কারণ ৩২ ধারায় যা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো প্রশাসনের দুর্নীতির গোপনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজকে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ অপরাধের দন্ড দেয়া হয়েছে আরো গুরুত্বর। প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, কী কী করলে গুপ্তচরবৃত্তি হবে ডিজিটাল আইনের ধারাগুলোয় তা আরও স্পষ্ট করা দরকার। আইন তৈরির আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। আর নতুন আইনটি কার্যকর হওয়ার পর আগে ৫৭ ধারার সব মামলা বাতিল করা উচিত। আইনে সেটিও উল্লেখ থাকা দরকার। পাস হওয়ার আগে এটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, তাই সাংবাদিকদের এখনই বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেজারুজ্জামান বলেছেন, দেশে ইন্টারনেট তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স¤প্রসারণের প্রেক্ষাপটে মত ও তথ্য প্রকাশ এবং সত্যানুসন্ধানের যে অবাধ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে অনুমোদিত হলে সেই সম্ভাবনা ধুলিসাৎ হবে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন- (বিএফইউজে) সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, নতুন আইনে অপরাধগুলো সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। তাই এটি স্পষ্ট করা দরকার। আইনটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে কিনা তা-ও দেখতে হবে। আগে ৫৭ ধারাও জনস্বার্থে করা হয়েছিলো, কিন্তু পরে সেটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুন আইন পাস করার আগে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মতামত নিতে হবে। ৫৭ ধারায় দায়ের করা আগের মামলাগুলো বাতিল করতে হবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ডিজিটাল আইন এমন ভাবে করা হচ্ছে; এটা বাকশালকেও ছাড়িয়ে যাবে।
বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়া আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় যে কথাগুলো সন্নিবেসিত ছিল; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সেই কথাগুলো চার ভাগে ভাগ করে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে ‘ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করলে স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা জাতির পিতার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রপাগান্ডা প্রচার করা হলে বা উস্কানি দেওয়া হলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা কিংবা উভয় সাজা প্রদান করা হবে। দ্বিতীয়বার সে একই অপরাধ করলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড কিংবা তিন কোটি টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ড প্রদান করা হবে।’ ২৫ ধারায় লেখা হয়েছে ‘কোনো ব্যক্তি জেনে-বুঝে যদি কাউকে আক্রমণ করার জন্য কিংবা ভীতি প্রদর্শন করতে কিংবা অপদস্থ করার জন্য ওয়েবসাইট কিংবা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে কিছু প্রকাশ বা স¤প্রচার করেন তবে তার তিন বছরের কারাদন্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি হতে পারে। কেউ ওই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে তার পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয়টিই হতে পারে।’ ২৮ ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছে ‘ধর্মীয় অনুভূতি কিংবা মূল্যবোধে আঘাত দিতে কেউ ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কিছু প্রচার বা স¤প্রচার করলে তার ৭ বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তিই হতে পারে। কোনো ব্যক্তি ওই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে তার ১০ বছরের জেল বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়টিই হতে পারে।’ ২৯ ধারায় ‘কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারার অপরাধ করেন তবে তার সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদন্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় শাস্তি হতে পারে। তিনি দ্বিতীয়বার ওই অপরাধ করলে তার ৫ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়টিই হতে পারে।’ এবং ৩২ ধারায় বলা হয় ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে কম্পিউটার গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’ প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের উল্লেখিত ধারাগুলো প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ৫৭ ধারা ছিল ভঙ্গকর; অনুমোদিত আইনটি আরও ভয়ঙ্কর। আইসিটি অ্যাক্টের যেসব সমালোচনা ছিলো বর্তমান আইনটি তার চেয়েও কঠোর করা হয়েছে। আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নাই। অনেক অস্পষ্টতা আছে। বিরোধী পক্ষকে দমনপীড়ন, নির্যাতন, জুলুম ও অবিচার করতেই এটি করা হচ্ছে। আইনটি পাস হলে দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা বলে কিছু থাকবে না। টিআইবি ও সিপিডির মতো যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিতে ওয়াচ ডগের কাজ করে, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে।
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারার কারণে মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও অনুসন্ধানী রিপোর্টের প্রয়োজনে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের অনেকেই গুপ্তচর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রাজপথে মানববন্ধন ছাড়াও ফেসবুক, বøগ, টুইটারে তারা নিজেদের মতামত তুলে ধরে বলছেন, বিতর্কিত ও নিবর্তনমূলক আইন ১৯৫২, জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮, বাংলাদেশ তফসিলী অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২, সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, জননিরাপত্তা আইন-২০০০, আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬, অতপর সংশোধনের মাধ্যমে ওই আইন ২০১৩ সালে ৫৭ ধারা সংযোজনের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের নিপীড়নের হাতিয়ার আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তারপরও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ হয়নি। মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তোলপাড় চললেও সিনিয়র সাংবাদিক, প্রবীণ আইনজীবী ও সুশীল সামজের প্রতিনিধিরা দাবী তুলেছেন প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে প্রেরণের আগে অংশিজনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হোক। বিজ্ঞানের বদৌলতে তথ্য প্রযুক্তির যে ব্যবহার বেড়েছে; তাতে এ ধরণের আইন প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কাউকে দলনের জন্য করা বাঞ্ছনীয় নয়। একই সঙ্গে তারা সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আইনমন্ত্রী যতই অভয় দিক না কেন; মিডিয়াকর্মীরা বিশ্বাস করছেন না। সরকারের প্রতি মিডিয়াকর্মীদের আস্থা সৃষ্টি করতে বিলুপ্ত আইসিটি অ্যাক্টের দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। এ ধরণের ঘোষণা সংবাদকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করবে। তখন তাদের সঙ্গে আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন