বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মানব হত্যা মহাপাপ

প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

মানব ইতিহাসে প্রথম সংঘটিত অপরাধ হলো মানব হত্যা। এটি শিরকের পরেই ‘কবীরা গোনাহ’ বা সবচেয়ে বড় অপরাধ। আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় পুত্র কাবিল প্রথম আপন বড় ভাই হজরত হাবিল (রা.)-কে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। এই প্রসঙ্গটি কোরআন মাজীদে এভাবে এসেছেÑ “আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদিগকে যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিলো তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। সে বললোÑ ‘আমি তোমাকে হত্যা করবোই’। অপরজন বললোÑ ‘অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন। আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত তুললেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত তুলবো না; আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করো এবং অগ্নিবাসী হও ইহাই আমি চাই এবং ইহা যালিমদের কর্মফল।’ অতঃপর তার চিত্ত ভ্রাতৃহত্যায় তাকে উত্তেজিত করলো। ফলে সে তাকে হত্যা করলো; তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো। অতঃপর আল্লাহ এক কাক পাঠালেন, যে তার ভ্রাতার শবদেহ কিভাবে গোপন করা যায় তা দেখাবার জন্য মাটি খনন করতে লাগলো। সে বললো, ‘হায়! আমি কি এই কাকের মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভ্রাতার শবদেহ গোপন করতে পারি?’ অতঃপর সে অনুতপ্ত হলো। এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা; হেতু ব্যতীত কেহ কাহাকেও হত্যা করলে সে যেনো দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করলো, আর কেহ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেনো সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো। তাদের নিকট তো আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণ এনেছিলো, কিন্তু এর পরও তাদের অনেকে দুনিয়ায় সীমালঙ্ঘনকারীই রয়ে গেলো। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় ইহাই তাদের শাস্তি যে, তাদিগকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদিগকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটিই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। তবে, তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার পূর্বে যারা তওবা করবে তাদের জন্য নয়। সুতরাং জেনে রাখো যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (আল কোরআন, পারা : ৬, পৃষ্ঠা : ১১৩-১১৪/১১-১২ হা., সূরা-৫ আল মায়িদাহ, আয়াত : ২৭-৩৪)।
ইসলামের শিক্ষা হলো : সকল মানুষ এক আল্লাহর বান্দা; যারা বিশ্বাসী তারা অনুগত বান্দা, আর যারা অবিশ্বাসী তারা পাপাচারী। সকল মানুষ একই পিতা মাতার সন্তান; সকল মানুষ একই রক্তে মাংসে গড়া; তাই সাদা কালোতে কোনো প্রভেদ নেই। সকল মানুষ আখেরী নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত। কালেমা পড়া মুসলমান সকলেই সমান। কবরে ও হাশরে সকলকে একই প্রশ্ন করা হবে।
কবরে প্রশ্ন করা হবে না, তুমি কি শিয়া ছিলে না কি সুন্নী ছিলে। প্রশ্ন করা হবে না, তুমি কি হানাফী ছিলে না কি সালাফী ছিলে। বরং প্রশ্ন করা হবে তুমি কি বিশ্বাসী মুমিন ছিলে? নাকি অবিশ্বাসী কাফির ছিলে? আরো প্রশ্ন করা হবেÑ তোমার জীবন পদ্ধতি কি ছিলো? এবং মানবতার মুক্তির দূত শান্তির নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তোমার জীবনাচারের কি সম্পর্ক ছিলো। প্রশ্ন তিনটি হবে এভাবেÑ ‘মান রব্বুকা, ওয়া মা দীনুকা, ওয়া মান হাযার রসূল’। অর্থাৎ তোমার রব্ব বা প্রভু কে? তোমার ধর্মাচার কি ছিলো? এবং এই ব্যক্তি (হজরত মুহাম্মাদ সা.) কে? একমাত্র সঠিক উত্তর হবেÑ ‘রাদীতু বিল্লাহি রব্বাওঁ ওয়া বিল ইসলামে দীনাওঁ ওয়া বি মুহাম্মাদিন (সা.) নাবীয়্যাওঁ ও রসূলা।’ অর্থাৎ আমার রব্ব আল্লাহ, আমার দীন-ধর্ম ইসলাম এবং হজরত মুহাম্মাদ (সা.) নবী ও রাসূল; এতেই আমি সন্তুষ্ট। হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যায় তিন বার করে এই দোয়া পড়বে (অর্থাৎ উপরোক্ত ঘোষণা দিবে), আল্লাহ তায়ালার উপর ওয়াজিব (অবধারিত) হয়ে যাবে কিয়ামতের দিন তাকে (জান্নাত দানের মাধ্যমে) খুশি করা।’ এবং তার কবরের সওয়ালের জওয়াব দেওয়া সহজ হবে। (তিরমিযী শরীফ, খ- : ৫, পৃষ্ঠা : ৪৬৫, হাদীস : ৩৩৮৯)।
ইসলামে মানব হত্যার পরকালীন বিধান সম্বন্ধে কোরআন মাজীদে বলা হয়েছে : “কেহ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রূষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।” (আল কোরআন, পারা : ৫, পৃষ্ঠা : ৯৪/১২ হা., সূরা-৪ আন নিসা, আয়াত : ৯৩)। আরো সতর্ক করে বলা হয়েছে : “আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করবে না।” (আল কোরআন, পারা : ৮, পৃষ্ঠা : ১৪৯/৭ হা., সূরা-৬ আল আনআম, আয়াত : ১৫১)। “আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না! কেহ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি উহা প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি; কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেনো বাড়াবাড়ি না করে; সে তো সহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে।” (আল কোরআন, পারা : ১৫, পৃষ্ঠা : ২৮৬/৪ হা., সূরা-১৭ আল ইসরা/বনী ইসরাঈল, আয়াত : ৩৩)।
মানব হত্যার জাগতিক বিধান সম্বন্ধে কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে : “হে মুমিনগণ! নিহতের ব্যাপারে তোমাদের জন্য ‘কিসাস’-এর বিধান দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস ও নারীর বদলে নারী, কিন্তু তার ভাইয়ের পক্ষ হতে কিছুটা ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সহিত তার দেয় আদায় বিধেয়। ইহা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে ভার লাৃৃ'ৃঘব ও অনুগ্রহ। এর পরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে।” (আল কোরআন, পারা : ২, পৃষ্ঠা : ২৮/৬ হা., সূরা-২ আল বাকারা, আয়াত : ১৭৮-১৭৯)।
ইসলামে মৃত্যুদ-ের যথার্থ কারণ তিনটি। প্রথমতঃ কোনো জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়ষ্ক মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে বিনা কারণে সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘কতল’ বা হত্যা করে এবং নিহতের অভিভাবক ও উত্তরাধিকারীগণ ‘দিয়াত’ বা রক্তপণ গ্রহণে সম্মত না হন। দ্বিতীয়তঃ কোনো জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়ষ্ক বিবাহিত মুসলমান যদি বিনা কারণে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ‘যিনা’ বা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তৃতীয়তঃ কোনো প্রাপ্তবয়ষ্ক জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান পুরুষ যদি ‘মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগী হয় এবং বিজ্ঞ প-িত আলেম-উলামা কর্তৃক তাকে ধর্ম-দর্শন ও ইসলামী বিশ্বাস ও বিধানের যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা বুঝানোর পরও যদি সে সত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এই তিনটি কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে কোনো মুসলমানকে হত্যা করা কোনোভাবেই বৈধ নয়।
ইসলামী শরীয়তের প্রধান উদ্দেশ্য হলো : জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা, বংশ রক্ষা ও ধর্ম রক্ষা। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, শরীয়তের মূল পাঁচটি লক্ষ্যের শেষটি হলো ধর্ম রক্ষা এবং প্রথমটি হলো জীবন রক্ষা; কারণ প্রাণ না থাকলে ধর্ম অচল। আজকাল অনেকেই সামান্য খুঁটিনাটি কারণে সন্ত্রাস, হত্যা, গুপ্ত হত্যাসহ খুনখারাবী করতে দ্বিধাবোধ করে না। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়; ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামে জীবন রক্ষার জন্য প্রাণবধের বিধান রয়েছে বটে; কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে হলে শরীয়া আইন অনুসরণ করতেই হবে। ইসলামী আদালত বা খলিফা কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি বিচারের দায়িত্ব পালন করবেন। কেউ যদি এমন কোনো অপরাধও করেন যাতে তার প্রাণ নিধনের বিধান আছে; তবে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাস্তবায়ন করা ইসলাম সম্মত নয়; বরং তা যথাযথ আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই কেবল বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখেন। কারণ কোরআন-হাদীসে বর্ণিত বিধি-বিধান যা অন্যের সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ ব্যক্তির একান্ত নিজের নয়; তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট তা কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় নিজেদের মতো করে বাস্তবায়ন করা শরীয়ত সিদ্ধ নয়; এটি কেবল মাত্র আদালত ও সরকারের দায়িত্ব।
লেখক : অধ্যাপক, সংগঠক ও চিন্তাবিদ

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
a.mumin ২৯ মার্চ, ২০১৬, ৩:০৭ পিএম says : 0
জীবন বাচানোও ফরজ।পৃথিবীর মজলুমদের কে রক্ষা করবে? কোন রাষ্ট?
Total Reply(1)
T. M. Abul Bashar ৩১ মার্চ, ২০১৬, ১:৪১ পিএম says : 4
Allah.

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন