শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

চরজমিদারদের হাতে বন্দি নদীভাঙনে সর্বহারা মানুষ

বিরূপ প্রকৃতির সাথে দখলদারদের নির্যাতনে দিশেহারা

প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : ‘পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই। আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।’ আব্দুল আলিমের জনপ্রিয় গানটি আধ্যাত্মিক ঘরানার হলেও পদ্মাচরের বাসিন্দারা গুনগুন করছেন ক্ষোভ ও হতাশার সাথে। এককালের প্রমত্তা পদ্মা এখন বালিচরের নিচে চাপাপড়া নদীর নাম। বছরের দশ মাস ঘুমিয়ে থাকলেও দু’মাস দাপট দেখায়। ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের ১০৯টি গেট দিয়ে পানি আটকে নদীকে মেরে ফেলা শুরু হয়েছে সেই সাড়ে চার দশক আগে থেকেই। একটু একটু করে বালি জমতে জমতে এখন পুরো নদী বালির নিচে চাপা পড়ে আর্তনাদ করছে। এপারের শহরের সমতলের চেয়ে কোথাও কোথাও চার-পাঁচ ফুট উঁচু নদীর বুক। শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা দিয়ে পানি আটকে এদেশের মানুষকে পানিতে মারা হলেও বর্ষার সময় ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দিয়ে একসাথে বিপুল পরিমাণ পানি ঠেলে দেয়া হয়। নাব্যতা হারিয়ে ফেলার কারণে একসাথে এত পানির চাপ ধারণ করতে পারে না পদ্মা। ফলে দু’কূল ছাপিয়ে চলে। ডোবায় ফসলের ক্ষেত, ভাঙে দু’পাড়ের জনপদ। নদীর দক্ষিণ-উত্তর দু’পাড় ভাঙে। শহরের উত্তর পাড়ে যেমন আঘাত হানে, তেমনি দক্ষিণের চরাঞ্চলে তা-ব চালায়। নদীর ভাঙন থেকে শহর বাঁচাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড অনেক পরিকল্পনা নিলেও হাজার একর জমি আর চরের বাসিন্দাদের রক্ষার তেমন উদ্যোগ নেয়নি। ফলে নদী সমানে দাপট দেখিয়েছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে সীমান্ত ফাঁড়িগুলো হারিয়ে গেছে। অনেক স্থানে বাংলাদেশের নদীর মালিকানা ভারতীয়দের দখলে চলে গেছে। নিজেদের নদীতে মাছ ধরতে গেলে বিএসএফ তাড়া করে গুলি করে মারে। ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়। ঘাম ঝরানো ফসলের ক্ষেতে ভারতীয় ঘোষ বাহিনী হামলা চালিয়ে ফসল লুটে নিয়ে যায়। তাদের জন্য কাঁটা তারের বেড়া কোন বাধা নয়। প্রকৃতি আর মানব সৃষ্ট দুর্যোগের সাথে লড়াই করতে করতে নিঃস্ব হয়ে গেছে দক্ষিণের চরাঞ্চলের মানুষ। শত শত জমি বসত বাড়ি সবি গেছে নদীর পেটে। সব হারানো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন স্থানে। চর তারা নগর, খিদিরপুর, খানপুর, চর জাজিয়া, চর মাঝাড়দিয়াড়, নামের গ্রামগুলো এখন অস্বিত্ব সংকটে। ‘চইর‌্যা’ নামে অভিহিতরা তাদের অস্বিত্ব হারাচ্ছে। যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারা উত্তরে শহরের পাড়ের আশেপাশে কিংবা আরো ভেতরের দিকে একখ- জমি কিনে ঘর বসতি গেড়েছে। আর যাদের সঙ্গতি নেই তারা মরা পদ্মার মধ্যখানে একটু উঁচু হয়ে জেগে থাকা চরে ঘর বসতি গেড়েছে। কোন রকমে ঠাই নিয়েছে। এখানেও তারা লড়াই করছে প্রকৃতি আর মানব দস্যুদের সাথে। বর্ষার সময় মাস দেড়েক থাকে চারিদিকে থৈ থৈ পানি। এসময় ঘরের মাচায় সাপ বিচ্ছুর সাথে লড়াই করে। বাকী সময়টাও রয়েছে প্রকৃতির বৈরী আচরণ। ফাঁকা চরের উপর দিয়ে বয়ে যায় কনকনে ঠা-া। আবার চৈত্র মাস থেকে শুরু হয় লু হাওয়ার সাথে লড়াই। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে দিনের বেলা ঘর হতে বের হওয়া দায়। প্রখর খরতাপ চরের বালিকে পরিনত করে উতপ্ত বালির কড়াইয়ে। গরম বালির ঝাপটা চোখে মুখে জ্বালা ধরায়। খুব সকাল আর বিকেলটা তাদের কাছে ভাল সময়। সন্ধ্যা নামলে হামলে পড়ে মশা। যেন মশার রাজ্যে বসবাস। মধ্যচর থেকে উত্তরের রাজশাহী মহানগরী দেখতে খুব সুন্দর দেখায়। আলো ঝলমল নগরটাকে মায়াবী মনে হয়। আর নিজেদের সম্বল বড় জোর হারিকেন আর কুপি বাতির আলো। তবে মাঝে মধ্যে চোরাকারবারী আর বিজিবির বড় টর্চের আলোর ঝলক হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়।
নগরীর বড়কুঠি ঘাট থেকে পদ্মার আবদ্ধ পানির খাল নৌকায় পেরিয়ে। উঁচু পাড়ে উঠে মাইল দেড়েক হাঁটার পর চরের মাঝখানে দেখা মেলে জীবনযুদ্ধে লড়াকু এসব মানবদের। পদ্মার মাঝ বরাবর চরটা বেশ খানিকটা উচু। বছর দুয়েক হলো খুব একটা ডোবেনা। তাই এখানে আবাস গেড়েছে নদীভাঙনে সব হারানো হাজার দেড়েক মানুষ। বড়কুঠি থেকে শুরু হয়ে পূর্বে তিন চার কিলোমিটার দূরে সাতবাড়িয়া পর্যন্ত এখানে সেখানে দু-চারটি করে পরিবার ঘরবসতি গেড়েছে। প্রশাসনের ভাষায় যা মধ্যচর নামে পরিচিত। চরের এসব বাসিন্দাদের খবর নিতে গিয়ে জানা গেল নানা কথা ভয় আর হতাশা। দেখা গেল চরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফসলের ক্ষেত। গমের সোনালি ক্ষেত আর ইরির সবুজ ধান গাছগুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে। কদিন আগে মশুর, কালাই ডাল কাটা হয়েছে। চরের বেগুন আর টমেটোর স্বাদ শহরে ক্রেতাদের নজর কেড়েছে। মিষ্টি কুমড়া, মরিচের আবাদও মন্দ নয়। পেঁয়াজ, রসুনও মোটামুটি আবাদ হয়েছে। সেচ দেবার জন্য চরের বুক ফুড়ে বসানো হয়েছে শ্যালো পাম্প। পানি পানের জন্য দু-চারটা নলকূপও রয়েছে। বড় ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ আর মেশিন দিয়ে গম মাড়ানোর দৃশ্যও নজর এড়ায়না। মজার ব্যাপার হলো মরুর বুকে যারা ঘাম শ্রম ঝরিয়ে মুরুদ্যান বানাচ্ছে। তারা কিন্তু এসবের মালিক নন। ওরা কামলা। চরের জমি স্বাভাবিক আইনেই সরকারের খাস খতিয়ান ভুক্ত। নদীর মালিক সরকার। কারো জমি ভেঙ্গে নদীর গর্ভে গেলেও নদী সকিস্তি হয়ে যায়। কিন্তু আইনে যাই থাকুক। পুরো চরের জমিদার রয়েছে দশ পনের জন। ওরা শহরে থাকে। বছরের দু’মাস নদী ভরে থাকার পর পানি কমতে থাকলে তারা চর দখলের মত লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে হামলে পড়ে। যার জোর যত বেশী। তার জমি তত বেশী। একেকজন পঞ্চাশ হতে পাঁচশো বিঘা জমির মালিক বনে যায়। এনিয়ে খুনোখুনি হয়। মাস্তান পোষে। চরে এরা হাসুয়া হাতে পাহারা দেয়। এসব বাড়ির মাঝে কারো কারো বাড়িও রয়েছে। কখন কারা চরে যাতায়াত করছে তার খবরা খবর রাখে। চরের ভুমিহীন মানুষগুলো ভয়ে তটস্থ থাকে। কথা বলতে মানা। সাহস করে মুখ খুলতে চায় না। পাছে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারাতে হয়। একদিন যাদের জমিতে অন্যরা কাজ করত। এখন সব হারিয়ে তারা যে অন্যের জমিতে কাজ করছে। ভুমির মালিক এখন ভূমি দস্যুদের শ্রমিক। চর ঘোরার সময় দলবদ্ধভাব লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের চলাচলের দৃশ্য নজর এড়ায়না। চরের দু’জন জমিদারের সাথে প্রতিবেদকের আলাপ হলে তারা জানান এ জমি তারা বাবা-দাদার সূত্রে প্রাপ্ত। বহুদিন আগে এসব জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। এখন চর হওয়ায় তারা চাষাবাদ করছে। তাদের নাকি জমির সব মালিকানার আপডেট কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ রয়েছে। যে আট দশজন জমিদারের নাম শোনা গেল তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে জমি জালিয়াতের মামলার নজিরও রয়েছে। কেউ কেউ বললেন তারা সরকারের কাছ থেকে লীজ নিয়েছে। এদের বেশীর ভাগের পেছনে রয়েছে সরকারী দলের সাইনবোর্ড। দলের এই সাইনবোর্ড তাদের বড় শক্তি। চরের এসব জমিদাররা সব হারানো আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোকে নিজেদের প্রজা মনে করে। তাদের ভাষায় এরা আমাদের জমিতে ঘর গেড়েছে। বড়কুঠির সামনের চর থেকে মাইল তিনেক হেঁটে সাত বাড়িয়া জাহাজঘাট সোজা বেশকটি ঘর বাড়ি দেখা যায়। চারিদিক খোলা একটি বৈঠকঘর খুব সহজে নজরে পড়ে। পাকা পিলার গুলো লাল সাদা ও সবুজ রং করা। পিলারের রং দেখে বিএসএফের কোন ঘর কিনা এনিয়ে প্রথমে সংশয় দেখা দিতে পারে। কাছে গিয়ে দেখা গেল সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনার এটির উদ্বোধন করেছেন। যার নাম দেয়া হয়েছে সমন্বিত কৃষি খামার। উঁচু পাকা মেঝেতে বসে যাতে চরবাসী বৈঠক করতে পারে সেজন্য এটি নির্মান করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে গোটা পাঁচেক টিউবওয়েল ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মান করে দিয়েছে। এক বাড়ি হতে অন্য বাড়ি গুলোর সাথে যোগাযোগের জন্য বালি দিয়ে রাস্তা তৈরী করা হচ্ছে। কেননা চরের জমিদাররা সব জায়গায় আবাদ করে বলে চলাচলে বাধা দেয়। চরের এসব ঘরবসতির মধ্যে জমিদারদের কিছু খাস লোক রয়েছে। যাদের শহরে পাকা বাড়ি রয়েছে। চরের নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে সরকারী বরাদ্দ নিতে এরা বেশ কিছু মানুষ আস্তানা গেড়েছে। এমন অভিযোগ প্রকৃত নিঃস্ব মানুষদের। দেখা মিললো সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের মেম্বারের। পঞ্চবটি সোজা চরের বসতিতে দেখা মেলে সুইস রেডক্রসের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হোমায়রা মাশতুরের। সাথে ছিলেন সিটি রেডক্রিসেন্টের নির্বাহী ডা. শামীম হোসেন চৌধুরী। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এরা এসেছেন চরবাসীদের জন্য কিছু করা যায়কিনা তার খোঁজ খবর নিতে। চরবাসী জানাচ্ছিলেন তাদের স্বাস্থ্য সেবার দুর্ভোগের কথা। কেউ অসুস্থ হলে শহরের হাসপাতাল ক্লিনিক তাদের ভরসা। তবে শহরে যাওয়া তত সহজ নয়। রাতের বেলাতো নই। অসুস্থ রোগীকে কাধে নিয়ে নদী নামক খাল পেরিয়ে তারপর শহরের পথ। এই খালের পারাপারও নিয়ন্ত্রন করে জমিদারের লোকজন। চিকিৎসক কবিরাজ কিছু নেই। দু-একটা মুদিখানার দোকান রয়েছে। সেখানে প্যারাসিটামল আর ব্যাথার ঔষধ পাওয়া যায়। অর্ধ-উলঙ্গ শিশু কিশোরের দল ছুটে বেড়ায় চরজুড়ে। তাদের নেই লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা। শিশুরা জানালো মসজিদের হুজুর আলিফ-বে-তে পড়ান। কোনো এনজিও এখন পর্যন্ত আসেনি বলে জানায় চরবাসী। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে যাওয়া হাজার দেড়েক চরবাসীর নিয়ে কারো ভাবনা নেই। তারা করুনা চাননা। চরের খাসজমি যদি সরকার তাদের মাঝে বন্টন করে দিত। তাহলে তাতেই তারা নিজেদের মত চাষাবাদ করে নিজেদের মত চলত। চরের জমিদারদের খড়গহস্ত থেকে রক্ষা পেত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন