পাহাড়-টিলা বন-জঙ্গল ধ্বংস ভরাট দূষণ ও তীরভূমি বেদখলের অনিবার্য পরিণতি
খর পার্বত্য নদীগুলো এখন স্রোতহারা
ফল-ফসল সেচ মৎস্যসম্পদ পর্যটন পরিবহন পরিবেশ-প্রকৃতিতে মারাত্মক প্রভাব
মাত্র সাত-আট মাস আগের কথা। চট্টগ্রাম অঞ্চলের খরস্রোতা পাহাড়ি নদ-নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ জনপদ পর পর তিন দফায় ভয়াবহ বন্যা কবলিত হয়। অথচ বর্তমান চিত্র ঠিক বিপরীত। শুষ্ক মওসুম পুরোপুরি না আসতেই খরস্রোতা পার্বত্য নদীগুলো স্রোতহারা। বইছে ক্ষীণধারায়। বৃহত্তর চট্টগ্রামের এক ডজনেরও বেশী নদ-নদীর যেদিকে চোখ যায় শুধুই ধূ ধূ বালুচর। নদীর বুকের ‘মাঠে’ ফুটবল হাডুডু খেলছে কিশোর-যুবকরা। শাক-সবজি ও পারিবেশঘাতী তামাকের চাষও হচ্ছে। নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় নদ-নদীতে ট্রলার নৌকা সাম্পান চালানো দায়। সারাদিন জাল ফেলেও তেমন মাছ মিলছে না। নির্বিচারে পাহাড়-টিলা, বন-জঙ্গল ধ্বংস, ভরাট, দূষণ ও তীরভূমি বেদখলের অনিবার্য পরিণতিতে এ অঞ্চলের নদ-নদীর প্রাকৃতিক স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ প্রায়। এতে করে কৃষি-খামার, ফল-ফসলের সেচকাজ, মৎস্যসম্পদ, পরিবহন, পর্যটনসহ সামগ্রিকভাবে পরিবেশ-প্রকৃতির উপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। গতবছর তিন দফা নজিরবিহীন বন্যায় তলদেশ ব্যাপকভাবে ভরাট হয়ে গেলেও নাব্যতায় নেই কোনো খনন কাজ। ফলে আগামীতে আবারও ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। মূল নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে খাল-ছরা, বিল ও জলাশয়ের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও টান ধরেছে। অর্থাৎ পানির মজুদ বা রিজার্ভার নিচের দিকেই নামতে শুরু করেছে। এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশ হয়ে উঠেছে রুক্ষ। হাজার হাজার হেক্টর জমি অনাবাদী পড়ে আছে সেচ সঙ্কটের মুখে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন ফসলা (তিন খোন্দ) চাষ হতো এমন বিস্তীর্ণ জমিতে আবাদ হচ্ছে দো-ফসলা, আর দো-ফসলা জমিতে এক ফসল শুধুই ফলানো সম্ভব হচ্ছে। অনেক জায়গায় আবাদি জমির উপর থেকে বিগত বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে আসা বালুর ঢিবি সরাতে পারেনি এখনও কৃষকরা। এ অবস্থায় আগেভাগেই নদ-নদীর মরণ দশায় পানির সঙ্কটে তাদের মাথায় হাত।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। মোট নদ-নদী ও উপনদীর সংখ্যা ৭শ’। দেশের ৪টি নদ-নদী অববাহিকা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা এবং দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য। পার্বত্য অববাহিকা তথা বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রবাহিত প্রধান নদ-নদী হচ্ছে কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, হালদা, সাঙ্গু, ফেনী, ইছামতী, মুহুরী, ডলু, ধুরং, গজারিয়া ইত্যাদি। শুকনো মওসুম মাত্র শুরু হতে না হতেই বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ি নদীগুলো তাদের স্বাভাবিক গতিধারা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক স্থানে এসব নদী বয়ে যাচ্ছে খাল-ছরা কিংবা নালার মতো সঙ্কীর্ণ ধারায়। উঁচু-নিচু টিলাময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইমোমধ্যে খরার পদধ্বনি দেখা দিয়েছে। পার্বত্য জেলাগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান অঞ্চলে নৌপথে যাত্রী এবং পণ্যসামগ্রী পরিবহনে সঙ্কট তৈরি হয়েছে নদীগুলো একযোগে নাব্যতা হারানোর কারণে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য শহর-গঞ্জে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার নিত্যপণ্যেরও দাম বেড়ে গেছে। পাহাড়ি অববাহিকার অন্যতম খরস্রোতা ফেনী নদী খুব দ্রুতই সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে খাগড়াছড়ির রামগড়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি-মীরসরাই সীমান্ত বরাবর নদীটির গতিপথ ঘেঁষে ভারত শতাধিক পাম্পহাউজ স্থাপন করে অবিরাম ফেনী নদীর পানি তুলে নিচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে বেপরোয়া বালু উত্তোলনের ফলে নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে এশিয়ায় একমাত্র মিঠাপানির মাছের প্রকৃতিক প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস জাতীয়) হালদা নদীর বুকে ও তীরজুড়ে নির্বিচারে দখল-বেদখল, দূষণ, ভরাট ও বাঁধ নির্মাণসহ পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ কারণে হালদায় মাছের বিচরণ ও প্রজননের পরিবেশ হুমকির মুখে রয়েছে। নদীটিকে ‘জাতীয় নদী’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সুষ্ঠু সংরক্ষণের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু তা উপেক্ষিত।
দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম পার্বত্য অববাহিকার নদ-নদীর বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া এখানকার নদীমালার দুর্দশা প্রসঙ্গে গতকাল (শুক্রবার) দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, বৃহৎ এই অঞ্চলের নদীগুলোর ভূ-প্রাকৃতিক বিশেষ অবস্থানের কারণে পৃথক কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব নদী ও খালের সংরক্ষণ প্রয়োজন। অন্যথায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন হলে দুর্যোগে বিশেষত বন্যা বা পাহাড়ি ঢলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যাবে। তিনি জানান, কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ফেনীসহ এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলো মূল্যবান মৎস্য সম্পদে এককালে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু অবাধে দখল, দূষণ, ভরাট, পাহাড় ধ্বংস, বন নিধনসহ বিভিন্ন কারণে এসব খরস্রোতা নদ-নদীর স্রোত হারিয়ে যেতে বসেছে। হরেক প্রজাতির মাছের অস্তিত্বও বিলুপ্তির মুখে। তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদ-নদীগুলোকে সুরক্ষার জন্য পাহাড়-জঙ্গল-প্রকৃতি সংরক্ষণ, নদী তীরবর্তী কল-কারখানাগুলো ও শহরাঞ্চল থেকে বর্জ্য-আবর্জনা নিঃসরণ রোধ এবং নদী খননের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একজন বিশেষজ্ঞ জানান, সকল সংস্থা ও বিভাগেরর নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অববাহিকার নদ-নদী সুরক্ষায় একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা প্রয়োজন। অন্যথায় এসব নদী অস্তিত্বটুকু হারিয়ে ফেলবে। কর্ণফুলী নদীর মতো সবচেয়ে খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর দূষণ, দখল, ভরাট রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। কেননা এই নদীটি চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে কর্ণফুলীর সুরক্ষা নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য। এর সাথে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়ভারের প্রশ্ন জড়িত। সমন্বয়ের বিকল্প নেই।
কর্ণফুলী নদী: এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী, যা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী। এর গতিপথের দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪৫৩ মিটার এবং গতিপথ সাপের মতো। কর্ণফুলী নদী ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এখানেই দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠেছে হাজার বছরের পথ পরিক্রমায়। নির্বিচারে ভরাট, দূষণ ও বেদখলের কারণে কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপক খননের অভাবে কর্ণফুলীর উজান এবং ভাটির উভয় অংশে চর, ডুবোচর সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে আসছে। নতুন চর, পলিমাটির ভূমি বেদখল করে কর্ণফুলীর ভাটিতেই গড়ে উঠেছে দুই হাজারেরও বেশী অবৈধ স্থাপনা। অবাধে ফেলা হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরীর যাবতীয় বর্জ্য। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বন্দর চ্যানেলের নাব্যতার উপর। কর্ণফুলীর অর্ধশত প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে।
মাতামুহুরী নদী : পার্বত্য বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ২৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী মাতামুহুরী। এ নদী চকরিয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। পাহাড়ি খরসোততা মাতামুহুরী নদীতে ব্যাপকভাবে জেগেছে ধূ ধূ বালুরচর। সুস্বাদু মাছ যাচ্ছে হারিয়ে। ফসল সেচে সঙ্কট বছর বছর বাড়ছে। উজানে পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে এ নদী সঙ্কটাপন্ন। নদী বুকের উর্বর বিরাট অংশে পরিবেশঘাতী তামাক চাষ হচ্ছে।
সাঙ্গু নদী : বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ২৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাহাড়ি খরসোতা নদী সাঙ্গুর গতিপথে এখন বিশাল অংশজুড়ে বালুচর। এ নদীর গতিপথে দখল, দূষণ ও ভরাট বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষের চাষাবাদ, জীবন-জীবিকা, প্রাকৃতিক সম্পদ, পর্যটন, পরিবহন, জীববৈচিত্র্যের সাথে সাঙ্গু নদীর বিরাট অবদান রয়েছে।
হালদা নদী : পার্বত্য খাগড়াছড়ি থেকে উৎসারিত এ নদী চট্টগ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ১০৬ কিমি গতিপথ নিয়ে কর্ণফুলীর মোহনায় মিলিত হয়েছে। হালদা কেবল এশিয়ায় মিঠাপনির একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র নয়; নদীটি ইউনেস্কোর শর্তানুযায়ী বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে যোগ্যতা ধারণ করে। হালদায় ডিম ও রেণু থেকে উৎপন্ন প্রতিবছর শত কোটি টাকার পোনা সমগ্র দেশে মাছ চাষে বিতরণ হয়। নদীর উৎস ও গতিপথে দূষণ ও ভরাট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
ফেনী নদী : খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গোড়ায় উৎপত্তি হওয়া ফেনী নদী ১৫৩ কিলোমিটার গতিপথে ওই জেলাসহ চট্টগ্রাম ও ফেনীর সীমানার উপর দিয়ে প্রবাহিত। নদীর অপর প্রান্তে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। নদীটির গড় প্রস্থ ১৫৯ মিটার হলেও ভারতের পানি শোষণ ও বিভিন্ন কারণে এর অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। সীমান্ত ঘেঁষে ভারতের স্থাপিত শতাধিক পাম্প দিয়ে শুকনো মওসুমের শুরু থেকেই ব্যাপকহারে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। এতে করে ফেনী স্বাভাবিক স্রোতধারা হারিয়ে দিন দিন মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। সেচকাজ, চা আবাদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন