স্টাফ রিপোর্টার : দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গতকাল হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ, পুলিশের গুলি ও সহিংসতায় অন্তত ৮ জন নিহত হয়েছে। দিনভর দুই পক্ষের গোলাগুলি, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও প্রার্থীর এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়া, ব্যালট ছিনতাইসহ নানা নাটকীয়তার স্থগিত ও বর্জনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় দলীয় প্রতীকে এই ভোট। প্রথম ধাপের মতোই এ দফাতেও ভোটকেন্দ্রে সশস্ত্র হামলা, ভাঙচুর, দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদের মারপিটের ঘটনা ঘটলেও পুলিশের অবস্থান ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। প্রিসাইডিং অফিসাররা বেশ কিছু এলাকায় জাল ভোটে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন। কয়েকটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে প্রিসাইডিং অফিসারদের আটক করেছে পুলিশ। তবে সারাদেশের সহিংসতার মধ্যেও ভোটে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন মনে করছে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ব্যতীত কোনো দলের কাছেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। সরকারের অন্যতম মিত্র জাসদের প্রার্থীরাও নির্বাচন বর্জন করেছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দেশের ৪৭ জেলার ৬৩৯ ইউপিতে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। এর আগে বুধবার রাত থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকারি দলের কর্মীরা প্রিসাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে ব্যালট পেপার ছিনতাই করে সিল মেরেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোট শুরুর সময় সব বাক্স ও ব্যালটের হিসাব না দিয়েই ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রিসাইডিং অফিসারদের সামনেই আবার কোথাও প্রিসাইডিং অফিসাররা নিজেরাই জালভোট দিয়েছেন। ভোট শুরুর আগ থেকে কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়া হয়েছে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের। ভোট শুরুর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মারধর করে উপস্থিত এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তৃণমূলের নৌকা-ধানের শীষের এ লড়াইয়ে মাঠে দাঁড়াতে পারেনি ধানের শীষ। বেশিরভাগ ইউপিতে বাধাহীন দখল করেছে সরকারদলীয় প্রার্থীরা। তবে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে বেধেছে সহিংসতা। দেশের বেশিরভাগ সহিংসতা ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সাথে হয়েছে।
জানা গেছে, সারাদেশের প্রায় সব ইউনিয়নে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার চর বাউরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। তারা হলেন, সানাউল্লাহ, ইব্রাহিম ও কামাল। এ ঘটনায় পুলিশ সদস্যসহ ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের ৫০ নম্বর মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোলাগুলিতে শিশুসহ দুজন নিহত হয়েছে। যশোর সদরের চাঁচড়া ইউনিয়নের ভাতুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলিতে আব্দুস সাত্তার ওরফে গোলাপ (৬০) নামে এক মুড়ি বিক্রেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। জামালপুর জেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। মাদারীপুর সদর উপজেলায় ভোট গণনার সময় ব্যালট পেপার ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে সুজন মৃধা এক আওয়ামী লীগ কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
আওয়ামী লীগের জয়জয়কার
এদিকে দখল-বর্জনের মাধ্যমে শেষ ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপের মতোই প্রায় সব ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করা হয়েছে। নৌকার বাইরে যে সমস্ত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে তারাও সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এর আগে বিনা ভোটে সরকারি দলের ৩১ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন গতকালের ভোটের শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত।
৫ প্রিসাইডিং অফিসার আটক
যশোরের জাল ভোট দিতে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ৩ প্রিজাইডিং অফিসার ও দু’জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হলেন, সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের কল্যাণদাহ ভোটকেন্দ্রের রফিকুল ইসলাম, উপশহর ইউনিয়নের শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের তৌহিদুল ইসলাম, কাশিমপুর ইউনিয়নের বিজয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের রফিকুল ইসলাম ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ইসরাত জাহান, চুড়ামনকাঠি ইউনিয়নের চুড়ামনকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল্লাহ বিন আকবর।
সরে দাঁড়ালেন শতাধিক চেয়ারম্যান প্রার্থী
সরকারি ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অভিযোগ এনে সকালে নির্বাচন বয়কট করেন সরকারের অন্যতম শরিক জাসদ সমর্থিত কয়েকজন প্রার্থী। এরপর থেকেই বিএনপি, স্বতন্ত্র সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জন করতে দেখা গেছে। সারাদেশে প্রায় ১০০ চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। বর্জনের তালিকায় রয়েছেন মেম্বার প্রার্থীরাও। চট্টগ্রামের তিন উপজেলার ৩০টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
অর্ধশত কেন্দ্রের ভোট স্থগিত
প্রিসাইডিং অফিসার-পোলিং অফিসারের ওপর হামলা, কেন্দ্রে ভাংচুর, ব্যালট ছিনতাই, বোমাবাজিসহ বিভিন্ন কারণে অর্ধশত কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করেছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা। তবে অনিয়ম ও সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৩ টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি। বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ তথ্য জানিয়েছে।
সব ইউপিতে ভোট দাবি বিএনপির
ইউপি দুই ধাপের নির্বাচন বাতিল করে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার বিকেলে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) গিয়ে এ দাবি জানায়।
দলের যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ সময় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সুজাউদ্দিন ও দলের সহ প্রচার সম্পাদক ইমরান সালেহ প্রিন্স উপস্থিত ছিলেন।
সাক্ষাৎ শেষে শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মকর্তা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রার্থী একাট্টা হয়ে যায়। তাই নির্বাচনে ভোট না হয়ে রক্ত ঝরছে। আমরা মনে করি এই দুই ধাপের নির্বাচন জনগণের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। আজকেও একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তবে কোনো দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেনি ইসি।
তিনি বলেন, ২৩ এপ্রিল তৃতীয় ধাপের ভোট তাদের কাছে সুষ্ঠু মনে না হলে বাকি তিন ধাপ বর্জন করবে তারা।
শাহজাহান বলেন, নির্বাচন কমিশন খারাপ নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইছে। সিইসির ক্ষমতা কী, তার যে কোনো ক্ষমতা রয়েছে, তার যথাযথ প্রয়োগ তিনি করতে পারছেন না। সিইসি মুখে না বললেও তার পুরো অবয়বে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
তিনি বলেন, দু-একজনকে শাস্তি দিলে তো হবে না। সিইসির যে একটা ক্ষমতা আছে, ইসি যে একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তার কোনো দৃষ্টান্ত আমরা দেখি না। উনারা কোনো সফলতা দেখাতে পারেননি। কোনো গ্রহণযোগ্যতা দেখাতে পারেননি।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে উনাদের একটা সুযোগ করে দিয়েছিল উল্লেখ করে শাহজাহান বলেন, কিন্তু আমাদের সেই সুযোগটা সরকারও গ্রহণ করেনি। সরকার যেহেতু গ্রহণ করেনি তাদের আজ্ঞাবহ ইসিও গ্রহণ করনি। তাই এই দুই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন চেয়েছি।
শাহজাহান আরো বলেন, আগামী নির্বাচনগুলো যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দর হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বলেছি। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে ইসি কোনো ব্যবস্থা না নিলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে।
ব্রতীর পর্যবেক্ষন থেকে জানা গেছে নির্বাচনে নানা ধরনের অনিয়ম, সংঘর্ষ ও প্রানহানীর ঘটনা ঘটেছে। ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে বেশকিছু এলাকায় বাধা দেওয়া, কেন্দ্র দখল, জোরপূর্বক ভোট প্রদান, ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনা জানা গেছে। ১৪টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহন স্থগিত করা হয়েছে। সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনায় সারা দেশে ৮ জন নিহত এবং দেড় শতাধিক আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
অনেক কেন্দ্রের বুথের ভেতর ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। সন্ত্রাস, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, অস্ত্র ব্যবহারসহ নানা উপায়ে বেশকিছু কেন্দ্রে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যালট ছিনতাই, ইচ্ছেমত সিল দিতে দেখা গেছে। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের কাছ থেকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতীকে সিল দিতে দেখা গেছে। এছাড়া ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়া, জাল ভোট প্রদান, নির্বাচন কর্মকর্তার ওপর হামলা কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেছে।
অধিকাংশ কেন্দ্রে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট উপস্থিত ছিল। কেন্দ্রের বাইরে সরকার সমর্থকদের বিপুল উপস্থিতি থাকলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম, পক্ষপাতসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশকিছু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম ঘটেছে বা সহিংসতা হয়েছে তার প্রতিটি ঘটনা নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে ব্রতী প্রত্যাশা করে। সহিংসতামুক্ত ও মানসম্পন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলো আরও তৎপর হবে বলে ব্রতী আশা করে। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতা প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশনকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন