বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলাম : আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথিকৃৎ

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ তিন ॥
উদাহরণ হিসাবে জায়েদ ইব্ন আলী এর মাজ্মু’র উল্লেখ করা যেতে পারে। জায়েদ ইব্ন আলী ১২০ হিজরী মুতাবিক ৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। অতীতকালের যে সমস্ত চুক্তিপত্র আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে সেগুলোর মধ্যে জায়েদ ইব্ন আলী’র চুক্তিপত্রটি সর্বাধিক প্রাচীন।
প্রসঙ্গক্রমে আরো উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের হাতে আন্তর্জাতিক আইন স্বতন্ত্র শাস্ত্র বা বিজ্ঞান হিসাবে বিকাশ লাভ করে। এমনকি ১৫০ হিজরীর পূর্বে প্রণীত বিভিন্ন বিবরণ বা রচনায় এতদসংক্রান্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। অবশ্য সে সময়ে আন্তর্জাতিক আইন বলতে স্বতন্ত্র কোন শিরোনাম ছিল না, ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত সিয়ার শীর্ষক শিরোনামে এ আলোচনা স্থান পেয়েছে। ইব্ন হাজর রচিত ‘তাওয়ালী আত-তাসীস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে পথম গ্রন্থ রচনা করেন হযরত ইমাম আবু হানীফা (র.)। তিনি ছিলেন জায়েদ ইব্ন আলী সমসাময়িক। এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে-
ক) এখানে সমস্ত বিদেশীকে একই পাল্লায় পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোন রকম তারতম্য বা কারো প্রতি কোনরকম পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি। খ) মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে এখানে কোন উল্লেখ নেই বরং গোটা বিশ্বের অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এ গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। বস্তুতপক্ষে ইসলাম নীতিগতভাবে স্থান, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে একটি সুতায় গেঁথে দিয়েছে। সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলেছে একটি জাতি। মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অবদান রয়েছে তুলনামূলক কেইস ল’-এর ক্ষেত্রে। ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিশেষ কোন আইনের ব্যাপারে কেন এ মতপার্থক্য দেখা দেয় অথবা এ জাতীয় মতপার্থক্যের ফলাফল কি হতে পারে তা নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। এখান থেকেই তুলনামূলক কেইস ল’-এর উদ্ভব ঘটে। এ বিষয়ের উপর দাবসী এবং ইব্ন রুশদ রচিত পুস্তকগুলো পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। সাইমুরী তুলনামূলক আইন বিজ্ঞান বা আইন পদ্ধতির উপর পুস্তক রচনা করেন। আরবী পরিভাষায় এ জাতীয় পুস্তককে বলা হয় উসূলে ফিক্হ।
মুসলমানগণই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের জন্য লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেন। বস্তুতপক্ষে নবী করীম (সা.) ছিলেন এ সংবিধানের রচয়িতা। তিনি যখন মদীনায় নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন এ সংবিধানটি প্রণয়ন করেন। ঐতিহাসিক ইব্ন হিশাম এবং আবু উবায়েদের বর্ণনার মধ্য দিয়ে এটা আমাদের হাতে পৌছেছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বিচার ব্যবস্থা প্রতিরক্ষা প্রভৃতি সকল বিষয় সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক তথা জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে স্পষ্টভাবে। ৫২টি ধারা সম্বলিত এ সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। এখানে ইসলামী আইনকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। (ক) ধর্মীয় আচার আচরণ, (খ) যাবতীয় চুক্তি সম্পর্কিত বিষয়সমূহ (গ) শাস্তি সম্পর্কিত বিষয়াদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইসলাম মানুষের জীবনকে দেখে সামগ্রিকভাবে। এখানে মসজিদ ও দূর্গের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এখানে রাষ্ট্রে বিধিবিধান বা সংবিধানের ধারাগুলো বিবেচিত হয় ধর্মীয় বিধি-নিষেধের অংশ হিসাবে। কারণ এখানে যিনি রাষ্ট্রের প্রধান, তিনিই ধর্মীয় নেতা ও মসজিদের ইমাম। আবার সরকারের রাজস্ব ও অর্থ ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয় ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে। কারণ, নবী করীম (সা.)-এর ঘোষণা অনুসারে সালাত, ইসলাম ও হজ্জের মতো এটাও (যাকাত) ইসলামের একটি স্তম্ভ। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক আইন দ-বিধির একটি অংশ। আর লুটতরাজ, ডাকাতি, রাহাজানি, আইন বা চুক্তি অমান্যকারীদের গৃহীত ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয় জেহাদের মর্যাদায়।
ইতিহাস এবং সমাজ বিদ্যায় মুসলমানদের অবদান প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে (ক) তথ্য নির্ভর এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, (খ) নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিচিত্র ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। ইসলামের ইতিহাস অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। এখানে পৌরাণিক কাহিনী বা কল্পলোকের কোন স্থান নেই। ইসলামের ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম ও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। হাজার বছর পরেও যাতে এর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন না ওঠে তা নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য। এমন একটি সময় ছিল যখন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল বিচার বিবেচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। মুসলমানগণ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করেন। প্রতিটি বিবরণের জন্য তাদেরকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হত।
ঐতিহাসিক সাক্ষী প্রমাণের বিষয়টি ছিল এ রকম- কোন এক সময়ে হয়তো একটি ঘটনা ঘটে গেল। সমসাময়িককালের বিশ্বাসযোগ্য কোন লোকের নিকট থেকে ঘটনার বিবরণও পাওয়া গেল। এমতাবস্থায় তার দেয়া বর্ণনাকে যথার্থ বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের সময় এ ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে হলে আনুক্রমিকভাবে দুটি সূত্রের উল্লেখ করতে হবে। যেমন- আমি ‘ক’-এর নিকট থেকে শুনেছি। আর ‘ক’ শুনেছে ‘খ’-এর কাছে। আর ‘খ’ হলো ঘটনার সমসাময়িককালের লোক এবং তার বিবরণও বিস্তৃত ও দীর্ঘ। আর তৃতীয় প্রজন্মের ক্ষেত্রে আনুক্রমিকভাবে তিনটি সূত্রের উল্লেখ করতে হবে। ইতিহাস রচনার এ ধারাটি কেবলমাত্র নবী করীম (সা.)-এর জীবনী রচনার মধ্যে সীমিত নয়। বরং যুগ-যুগান্তর ধরে যে সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান আমাদের নিকট পৌঁছেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এ কৌশলটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি নিছক রস-কৌতুক ও গল্প-কাহিনীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ আনুপূর্বিক বর্ণনাকারীর বিবরণ পাওয়া যাবে। মুসলমানদের ইতিহাস চর্চার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল জীবনীভিত্তিক অভিধান প্রণয়ন। অভিধানগুলো সংকলন করা হয়েছিল বিভিন্ন পেশা, শহর বা স্থান, শতাব্দী বা ঘটনাপ্রবাহ প্রভৃতি বিষয় অনুসারে। অনুরূপভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল বংশ-বৃত্তান্তের উপর। বিশেষ করে আরবদের ক্ষেত্রে ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টায় এ ধারাটি বেশি প্রযোজ্য। গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য ব্যক্তিত্ব এতে স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে এটা ঐতিহাসিক গবেষকগণের জন্য খুবই সহায়ক ছিল।
মুসলমানদের রচিত ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সামগ্রিকতা। ইসলাম পূর্ব যুগের ঐতিহাসিকগণ কেবলমাত্র জাতীয় ইতিহাস রচনা করতেন। তদস্থলে মুসলমানগণই সর্বপ্রথম বিশ্বের ইতিহাস রচনার প্রতি মনোনিবেশ করেন। উদাহরণ হিসাবে ইবন ইসহাকের কথা বলা যেতে পারে। তিনি ৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন এবং ইসলামের প্রথম কালের একজন ঐতিহাসিক। তার বৃহদাকারের ইতিহাস গ্রন্থের শুরুতেই রয়েছে বিশ্ব জগতের সৃষ্টির বিবরণ। এরপরই এসেছে আদিপিতা হযরত আদম (আ.)-এর বৃত্তান্ত। কালের অন্যান্য জাতি ও গোত্রের বিবরণও স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। বস্তুতপক্ষে ইব্ন ইসহাকের উত্তরসূরীগণও ছিলেন একই ধারার অনুসারী। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তারাও সামগ্রিকতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন। এদের মধ্যে ছিলেন ইব্ন কাছীর, তাবারী মাস’উদী, মিশকাভি, সাইদ আন্দালুসী, রশীদুদ্দীন খান এবং আরো অনেকে। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ সমস্ত ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনার সময় সমসাময়িক কাল সম্পর্কে একটি বিবরণ তুলে ধরেন। বিশেষ করে ইব্ন খালদুনের দার্শনিক এবং সমাজ বিদ্যা সম্পর্কিত আলোচনা ছিল খুবই ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। তার রচিত বিশ্ব ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের ভূমিকায় (মুকাদ্দমা) এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে খুবই স্পষ্টভাবে।
ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি ধারাকে বলা যায় পুরোপুরি ইসলামের ইতিহাস, নবী করীম (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন ও কর্ম এর প্রধান উপজীব্য। অন্য ধারায় রয়েছে অমুসলিমদের ইতিহাস। ইসলামপূর্ব যুগের আরব থেকে শুরু করে সমসাময়িককালের বিশ্ব পরিস্থিতি যেমন- রোম, পারস্য এসবই ছিল অমুসলিমদের ইতিহাসের বিষয়বস্তু। বস্তুতপক্ষে হিজরী প্রথম শতাব্দীতেই ইতিহাস রচনার এ দুটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন