শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইসলামে কন্যা হিসেবে নারীর মূল্যায়ন

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ আবুল খায়ের স্বপন

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহপাকের জন্য। দুরুদ ও সালাম জানাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, নারী জাতির মুক্তির ত্রাণকর্তা বিশ^ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর। নারী জাতি মানব সমাজেরই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারী সৃষ্টি জগতের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক অনুপম, অভিনব এবং অতুলনীয় সৃষ্টি। নারীরা এ সমাজেরই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহান আল্লাহর সৃষ্টিতে নর এবং নারী একে অন্যের পরিপূরক। ইসলামের দৃষ্টিতে নর এবং নারীর স্থায়িত্ব এবং শান্তি তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। সামান্য আনন্দেই নারীর বদনে খেলে হাসির উদ্বেল লহরী। নারীরা পুরুষের (স্বামীর) জীবনের আবাহন, পুলকের সঙ্গিত, পবিত্র ¯েœহ, মমতার প্রতীক প্রতিমূর্তি। তারা বিশ^ নিখিলের প্রাণ সম্পদ। বিশ^ নিখিলের ছবিতে যা কিছু চাকচিক্য তা সবই এ নারীর কল্যাণেই। গোটা বিশ^ মানবতাই নারীর কাছে ঋণী। সৃষ্টি জগতের যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর সেখানেই নারীরা আছে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এ পৃথিবীতে প্রচলিত প্রাচীন ধর্মগুলোতে নারীকে সব পাপ কর্র্মের প্রধান উৎস মনে করা হতো। এমনকি তারা মনে করত নারীরা হচ্ছে শয়তানের বাহন, এরা বিষধর সাপ যা পুরুষকে দংশন করতে কখনো দ্বিধা করেনি। এমনকি তারা নারীর কন্যার ক্ষেত্রে ‘দুহিতা’ (গাভী দোহনকারিণী) এবং স্ত্রীর জন্য ‘পতœী’র (বাঁদী) মতো আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করত।
কোনো কোনো প্রাচীন ধর্মে যুবতী কন্যাকে তাদের দেবতার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কিংবা বৃষ্টি অথবা ধন-দৌলত লাভের মরীচিকা আশায় বলিদান দিত। জাহিলী আরব সমাজে জীব হিসেবে কন্যা সন্তানদের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা ছিল অবহেলিত, উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত এবং করুণার পাত্রী। কন্যা সন্তান জন্ম হওয়া তাদের কাছে অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে গণ্য হতো। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। কোনো কোনো আরব গোত্রে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তারা অপমানিত এবং লজ্জিত হতো। আর এ লজ্জা এবং অপমান থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় তাদের জীবন্ত কবর পর্যন্ত দিতে তারা দ্বিধা করত না। কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়াকে তারা বৈধ মনে করত। এমনকি এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনার লেশমাত্র ছিল না। জাহেলি যুগের দাহইয়া কালবী যার বাস্তব উদাহরণ যিনি নিজ কন্যাকে জীবন্ত কবর দিয়েছেন। (পরে অবশ্য তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে তার অতীত জীবনের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর দরবারে খালেস তওবা করেছেন)।
জাহেলি যুগে কন্যা সন্তানদের প্রতি আরবদের নিষ্ঠুর আচরণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ৫৮নং আয়াতে ইরশাদ করেনÑ “যখন তাদের কাউকে মেয়ে শিশুর সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের মুখ কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনোকষ্টে ক্লিষ্ট হতে থাকে।” মানবতার ধর্ম ইসলাম আরবে প্রচলিত কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়ার এ ঘৃণিত রীতি চিরতরে বন্ধ করে কন্যা সন্তানকে ছেলে সন্তানের মতো জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার দেন। এমনকি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের সূরা আত তাকভীরে ইরশাদ করেনÑ “জীবন্ত প্রোথিত কন্যা সন্তানকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল।” তাদের এহেন ক্রান্তিলগ্নে তাদের সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা, অবজ্ঞা এবং অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার থেকে পরিত্রাণ দিয়ে সম্মান, মর্যাদা এবং গৌরবময় সামাজিক জীব হিসেবে জীবনযাপনের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে এই বিশ্বধরায় আবির্ভূত হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)। তাঁর আনীত জীবন ব্যবস্থা ইসলামই অবহেলিত কন্যা সন্তানদের সামাজিক জীব হিসেবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে।
ইসলাম সমাজ থেকে শ্রেণি এবং বংশগত বৈষম্যের চির অবসান করে। ইসলাম মনে করে নারী-পুরুষ একই সত্তা থেকে সৃষ্টি একই বংশ থেকে নিঃসৃত।
ইসলামই নারীদের যুগযুগ সিঞ্চিত অপমান, লাঞ্ছনাহীনতার পুঞ্জীভূত স্তূপের জঞ্জাল থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তিদান করে এবং তাদের ললাটস্থ সহা¯্রব্দকালের কলংকের মসীরেখা মুছে দেয়। ইসলাম নারীদেরকে জীবনের প্রথম লগ্নে কারো কন্যা যৌবনে এসে কারো বধূ এবং জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে কারো মমতাময়ী মা হিসেবে যে সম্মান এবং মর্যাদার স্বর্ণশিখরে অধিষ্ঠিত করেছে তা পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যান্য সব ধর্মে সত্যিই বিরল। কন্যা সন্তান জন্মলাভ করা মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে ইসলামে স্বীকৃত। কন্যা সন্তানদের মর্যাদার ব্যাপারে মিশকাত শরিফের হাদিসে নবীজি (সা.) ইরশাদ করেনÑ “যে ব্যক্তি দুই কন্যা বা ভগিনীপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে এবং পুরুষদিগকে (ছেলে/ভাই) তাদের ওপর প্রাধান্য দেবে না সেই ব্যক্তি আর আমি কেয়ামতের দিন এমনভাবে অবস্থান করব যেভাবে দুটি আঙ্গুল একত্রে থাকে।” একই প্রসঙ্গে বুখারি শরিফে সাহাবি হযরত উকবা বিন আমির (রা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-কে বলতে শুনেছিÑ “যে লোকের তিনটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করে (তাদেরকে বোঝা মনে করে না) এবং সাধ্যানুসারে ভালো খাওয়ায়, পরায়, তাদের সঙ্গে দয়াদ্র ব্যবহার করে, তার জন্য বেহেশত অবধারিত”। হাদিসে আরও উল্লেখ আছেÑ “যে ব্যক্তির তিনজন মতান্তরের দুই/একজন মেয়ে বা বোন রয়েছে সে যদি তাদেরকে লেখাপড়া এবং শিষ্টাচার শেখায় এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে তাহলে বেহেশত তার জন্য অবধারিত”। মুসলিম শরিফের ১৪১ নং হাদিসে নবীজি (সা.) কন্যা সন্তানের মর্যাদার ব্যাপারে আরও ইরশাদ করেনÑ “ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা। তাহার দুঃখ দর্শনে আমি কষ্ট অনুভব করি”। পৃথিবীর কন্যা সন্তানদের পিতাদেরকে উদ্দেশ করে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেনÑ “যখন কোনো দুরদেশ সফরে বাহির হও তখন সবার শেষে কন্যাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে আর ফিরে এসে সবার আগে তাদের খোঁজ নেবে এবং তাদের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে আসবে”। তাছাড়া পবিত্র কোরআনের অন্য এক আয়াতে আল্লাহপাক হযরত মরিয়ম (আ.)-এর মাতাকে সান্ত¦না দিয়ে ইরশাদ করেন “যে ছেলে তুমি চেয়েছিলে, সে তো এ মেয়ের মতো নয়! যাকে তোমাকে দেওয়া হয়েছে”।
তাছাড়া আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন পাকে ছেলে (পুরুষ) নামে কোনো সূরা নাজিল করেননি বরং মেয়ে (নিসা-নারী) নামে সূরা নাজিল করেন। এতে সহজেই বোঝা যায়, পবিত্র কোরআন পাকেও মেয়েদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে। জাহিলিয়াত যুগে নারী এবং কন্যা সন্তানদেরকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চরমভাবে পঙ্গু করে রাখা হতো। মীরাসে তাদের কোনো অধিকার ছিল না বরং তারা নিজেরাই মীরাসের সম্পত্তি হিসেবে অন্যদের মাঝে বন্টিত হয়ে যেত। কিন্তু মানবতার ধর্ম ইসলাম চরম অবমাননাকর এ রীতি চিরতরে বন্ধ করে তাদেরকে মীরাসের অংশীদার নির্ধারণ করে দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের সূরা নিসায় উল্লেখ করেনÑ “আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে তোমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক বিধান দিচ্ছেন তিনি আদেশ করছেন একজন পুরুষ দুজন মেয়েলোকের সমান অংশ পাবে। কেবলমাত্র মেয়ে সন্তান দুজন কিংবা ততধিক হলে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে, আর যদি একজন মাত্র কন্যা সন্তান হয় তাহলে সে মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে”। তাছাড়া ইসলাম কন্যার বিবাহ সম্পর্কে তার অভিভাবকদের ওপর তার মতামত গ্রহণ অপরিহার্য বলে নির্দেশ প্রদান করেন। এমনকি ইয়াতিম মেয়েদের বিবাহর ক্ষেত্রেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আবু দাউদ শরিফে বিশ্ব নবী (সা.) ইরশাদ করেনÑ “ইয়াতিম মেয়েকে তার স্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত বিয়ে দেওয়া যেতে পারে না”।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন