শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সড়কনির্ভর চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহনে অবহেলিত নৌপথ

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪১ পিএম, ২ এপ্রিল, ২০১৬

শফিউল আলম : চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্যসামগ্রী পরিবহন ব্যবস্থা বর্তমানে সড়কপথে পুরোদমে একমুখী হয়ে পড়েছে। বিকল্প সুবিধাজনক হলেও বন্দর থেকে আমদানি-রফতানিমুখী মালামাল নৌপথে ও রেলযোগে পরিবহন করা হচ্ছে খুব কম হারে। এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও আন্তঃজেলা বিভিন্ন রুটে নিত্যদিনের যানজট সমস্যা খুবই প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাছাড়া বিভিন্নমুখী জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও মাঝপথে পণ্যসামগ্রী চুরি, লোপাট এবং জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়েই চলেছে। অথচ তা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরমুখী ও বহির্মুখী পণ্যসামগ্রী নৌপথে ও রেলপথে সমন্বিত পরিবহনের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানিমুখী পরিবাহিত পণ্যসামগ্রীর মধ্যে ৮০ শতাংশের গন্তব্যই হচ্ছে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকা, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ এলাকা। এরপর রয়েছে দেশের অন্যান্য জেলা উপজেলা সদর, নৌ-বন্দর ও গঞ্জগুলো। চট্টগ্রাম প্রধান সমুদ্রবন্দর থেকে বছরে ২০ লাখ ১৫ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার এবং সাড়ে ৫ কোটি মেট্রিক টন পণ্যসামগ্রী পরিবহন করা হয়। এত বিপুল পরিমাণ পণ্যসামগ্রী সামাল দেয়ার উপযোগী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেশে নির্মিত হয়নি এখনও। বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্য নিয়ে মহাসড়ক পাড়ি দিতে গিয়ে মালামাল বোঝাই পিঁপড়ের মতো সারি সারি ট্রাক কাভার্ডভ্যান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের প্রধান সড়ক-মহাসড়কসমূহকে প্রায় স্থবির করে দিচ্ছে প্রতিদিনই। সুষম পরিবহন নীতি চালু না থাকার কারণেই এমনটি ঘটছে। অথচ সমুদ্র বন্দর ও নৌ-বন্দরের সুবিধা রয়েছে বিশ্বে এমন প্রায় সব দেশ কম জ্বালানি ব্যয়ে অধিক পরিমাণে মালামাল পরিবহনের জন্য আগের তুলনায়ও এখন নৌপথে পরিবহনের দিকেই বেশিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে। দেশের নৌ-পরিবহন বিভাগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞের জরিপ অনুসারে সড়ক-রেল-নৌপথে মালামাল পরিবহনের যে আনুপাতিক খরচ হয় তাতে নৌপথই সবচেয়ে বেশি ব্যয় সাশ্রয়ী। বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আকাশপথ, রেল কিংবা সড়কপথের তুলনায় আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী পরিবহন ব্যবস্থায় নৌ-পথ অনেক বেশি আর্থিক সাশ্রয়ী ছাড়াও সহজতর হিসেবেই বিবেচিত। যা সড়কপথের তুলনায় চারগুণ বেশি খরচ সাশ্রয়ের নিশ্চয়তা দেবে।
এদিকে রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে নৌপথে চাল, গম, চিনি, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, সার, বীজসহ কৃষি উপকরণ, সিমেন্ট ক্লিংকার, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল, রফতানিমুখী গার্মেন্টস প্রভৃতি পণ্যসামগ্রী পরিবহন অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী। কিন্তু নৌ-পরিবহনখাত ব্যাপকভাবেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে নৌপথে পণ্য পরিবহনের বিরাট সুযোগ তেমন কাজে আসছে না। বরং ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়েছে নৌপথ। সুলভ পরিবহনের জন্য দেশের নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সচল করার ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করা সত্ত্বেও এ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বেড়াজালে তা বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকার এ বিষয়ে একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- জনসংখ্যার তুলনায় ক্রমেই সীমিত হয়ে পড়া সড়ক ও রেলপথে অতিমাত্রায় চাপ ও নির্ভরতা হ্রাস। সাগর মোহনা উপকূল ঘেরা, নদীমাতৃক দেশের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য নৌপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহায়ক। একে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সদ্ব্যবহার।
পোর্ট শিপিং সার্কেলে জানা যায়, দেশে সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়ক নির্ভরতায় মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সড়কপথে চাপ কমানোর ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমদানি-রফতানিমুখী ও কৃষি-খামারজাত উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত সুবিধা বৃদ্ধি, জনসাধারণের নিত্যপণ্য পরিবহনে ব্যয় সাশ্রয় করতে প্রধান বিকল্প অভ্যন্তরীণ নৌ-রুটগুলো সচল করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতিসঞ্চার। নদীমাতৃক হলেও পলি-বালিমাটি ও বর্জ্যে ভরাট, ভূমিদস্যুদের বেপরোয়া দখল, পরিবেশ প্রতিবেশ বিপর্যয়, নদীর উৎসমুখে নিয়ন্ত্রণসহ বহুবিধ কারণে অধিকাংশ নদ-নদী, উপনদী, শাখানদী স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়েছে। দেশে স্বাভাবিক স্রোতোবাহী নৌপথের দৈর্ঘ্য ১৮ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি।
তবে প্রমত্তা বেশিরভাগ নদী ভরাট হয়ে নাব্যতা হ্রাস পেয়ে অনেকক্ষেত্রে মরা খালে পরিণত হয়েছে। এ কারণে দেশের বিস্তীর্ণ নৌপথ আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। নদীর সংস্কার বা ড্রেজিং না হওয়ায় নাব্যতা হারিয়ে কার্গোজাহাজ, লাইটারেজ জাহাজ, কোস্টার, ট্যাংকার, বার্জসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক নৌযান চলাচল অনেকক্ষেত্র বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অনেক জায়গায় চর ও ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে কার্গোজাহাজ, লাইটার, নৌযান। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে বেকারত্বের মুখে পড়েছে নৌ-পরিবহন খাতের হাজার হাজার শ্রমিক, মাঝি-মাল্লা ও নৌযান মিস্ত্রী-কারিগর। নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হলে হরেক পণ্যসামগ্রী প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবাহিত হবে অনেক সহজ উপায়ে। এরফলে নিত্য ও ভোগ্যপণ্য, শিল্প ও কৃষি উপকরণের দাম অনেকাংশেই কমে আসবে।
এদিকে নদীমাতৃক এ দেশের নদ-নদীমালার নাব্যতা পুনরুদ্ধার ও নৌযান চলাচলের উপযোগী করে ড্রাফট (গভীরতা) বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত প্রেক্ষিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আওতায় নদ-নদী পথে নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নৌপথের নাব্যতা বাড়ানো, নৌ-যোগাযোগে আমূল উন্নতির লক্ষ্যে নৌ-যোগাযোগ পরিবহন খাত উন্নয়ন সম্পর্কিত সরকারের দিক-নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নৌপথ সর্বাপেক্ষা সহজ, ব্যয় সাশ্রয়ী। আর্থিক বিবেচনায়ও সম্ভাবনাময় সম্পদ হয়ে উঠতে পারে নৌখাত। এর জন্য নৌপথের সদ্ব্যবহার অপরিহার্য। নৌপথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন খাত পুনরুজ্জীবিত হলে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হতে পারে।
এদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনের উদ্যোগ বারবার থমকে যাচ্ছে। বন্দর থেকে সরাসরি নতুন উদ্যমে কন্টেইনারজাত পণ্যসামগ্রী পরিবহন চালু হলেও তা অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের কাছে পানগাঁওয়ে ছোট আকারের কন্টেইনার ফিডার জাহাজযোগে পণ্য পরিবহন শুরু করা হয়। এতে আশা করা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কন্টেইনার পরিবহনের জন্য শুধুমাত্র সড়ক ও রেলপথের উপর নির্ভরতা কমে আসবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্মিত নারায়নগঞ্জের পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনালে সাশ্রয়ী মূল্যে এবং নিরাপদে কন্টেইনার পরিবহনের লক্ষ্যে বন্দরের নিজস্ব উদ্যোগে ৩টি কন্টেইনার জাহাজ ‘এমভি পানগাঁও এক্সপ্রেস’, ‘এমভি পানগাঁও সাকসেস’ ও ‘এমভি পানগাঁও ভিশন’ সংগ্রহ করা হয়। নৌপথে কন্টেইনার পরিবহনে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উক্ত ৩টি জাহাজ বিগত ২ সেপ্টেম্বর’১৫ইং মেসার্স সামিট এলায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের কাছে পরিচালনার জন্য হস্তান্তর করা হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শিপিং এজেন্ট, এমএলও’দের সাথে চুক্তির মাধ্যমে কন্টেইনার পরিবহন শুরু করে ২৩ সেপ্টেম্বর’১৫ইং। এরফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর যানবাহনের বিশেষত ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের চাপ কমবে এমনটি প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। অথচ ব্যবসায়ীমহল তথা বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না থাকায় পানগাঁও আইসিটির নৌপথে কন্টেইনার পরিবহন ব্যবস্থা নিয়মিত চালু রাখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা চট্টগ্রাম বন্দর-পানগাঁও নৌপথে কন্টেইনার পরিবহন সচল রাখার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন